দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে প্রথমবারের মত বিশ্ব দরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকার কারণে ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ বাংলাকে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন।
বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ কেবল ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। এই অনুমান পরিসংখ্যানবিদদের। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
কিন্তু আমাদের ভাষাটা নিয়ে আমাদের এত এত আগ্রহ কিংবা এত মাথা ব্যথা কেন?
একটা দেশের স্বাধীনতার ভিত্তি যে হতে পারে ভাষা, তা হয়ত পৃথিবীর কোন জাতি কোনকালেই টের পেত না, যদি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের জন্য আমাদের জাতির সূর্য সন্তানেরা প্রাণ না দিতেন।
বই পুস্তকে পড়ানো হয় আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। আসলে বক্তব্যটি সত্য নয়। আমি নিজেও ছোটবেলা থেকেই এই ধারণায় ছিলাম, “আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি”। খুব অল্প সময় হলো এই বিষয়ে জেনেছি তবে এতটা গভীর কিছু নয়। যতটুকু জেনেছি ততটুকু লিখছি…
১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষনা দেয়, সেখানকার বাঙালীরা তা না মেনে আন্দোলনে নামেন।
১৯৬১ সালের ১৯ মে এ আন্দোলনে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে প্রাদেশিক পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডিচরন সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তারিণী দেবনাথ, সুনীল সরকার, সুকুমার পুরকায়স্থ। যাদের মধ্যে কমলা ভট্রাচার্য পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষা শহীদ হিসেবে স্বীকৃত।
আবার আসামেই বাংলা ভাষার জন্য ১৯৭২ সালের ১৭ আগষ্ট আরও একজন এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই আরও দুজন শহীদ হন।
এছাড়াও ১৯৯৬ সালে ১৬ই মার্চ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার জন্য প্রাণ দেন পৃথিবীর দ্বিতীয় নারী ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ। ভারত বাংলাদেশের মনিপুরীরা ১৯ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন।
সুতারাং পৃথিবীতে মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া একমাত্র জাতি আমরা নই, বরং আমরা জাতি হিসেবে প্রথম, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। আমাদের ভাষা আন্দোলন কোন অসুস্থ মস্তিষ্কের প্রয়াস নয়, তাহলে আমাদের প্রজন্মকে কেনো ভ্রান্ত ও মিথ্যা শিক্ষা দেওয়া হবে? এসব মিথ্যাচার তো কোনো কালেই একুশের চেতনা ছিলো না!
আমাদের কাছ থেকে উদ্ভুদ্ধ হয়েই অন্য জাতিরাও মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, এটাই আমাদের গর্বের কারণ হওয়া উচিত। জাতি হিসেবে আমরা এজন্যই গর্বিত, এজন্যই আমাদের ভাষাটাকে আমরা মাথায় তুলে রাখতে চাই যে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের সুত্র ধরেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। আমাদের বর্ণ গুলোকে নীরবে কাঁদতে দেইনি। বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়ে পুরো বিশ্বে প্রথমবারের মত মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে আমাদের অগ্রজরা…
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরদের জন্য। পৃথিবীর সকল জাতির মাতৃভাষার বর্ণগুলো সূখী হোক।
মুক্তিকামী জনতার জয় হোক, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হোক সকল স্বাধীনতাকামীরা…