বলা হয়ে থাকে, আমরা এগোচ্ছি। ইদানিং আশপাশে তাকালে মনে হয়, আমরা ঠিকই এগোচ্ছি। তবে সেটা যতটা না সামনের দিকে, তারচেয়ে বেশিটাই বোধহয় পিছনের দিকে ! এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না, তবে হচ্ছে কেনো?
আমরা এখন মোটিভেশন নিচ্ছি হিরো আলম থেকে। বগুড়ার ডিস ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম কিভাবে হিরো আলম হলো তা আমরা সবাই জানি। ৮ হাজার টাকা মূল্যের ডিজিটাল ক্যামেরায় মিউজিক ভিডিওর নামে অর্ধ পর্ণ ভিডিও বানিয়ে একগাদা মেয়েকে যতটা পারা যায় কম পোশাক পরিয়ে অসভ্য ডায়ালগ, সাথে ভাঁড়ামি মিশিয়ে আজ ডিস ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম থেকে হিরো আলম হয়েছে !
এবার একুশে বইমেলায় হিরো আলমের একটা বই বের হয়েছে। বইয়ের নাম “দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, আমরা সমাজকে বদলে দেবো”। বইয়ে হিরো আলমের চৌম্বক ১০টি উক্তি দিয়ে দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে যাচ্ছে। এই তো কিছুদিন আগে মানুষ হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ ছফা’র উক্তি শেয়ার দিত। এখন শেয়ার দিচ্ছে হিরো আলমের উক্তি ! কিভাবে পেছনের দিকে দৌঁড়ানো যায়, সেটাতেই যেনো ব্যস্ত সবাই !
আমি মোটেই ‘ব্যক্তি আশরাফুল আলম’কে ছোট করছি না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে হিরো আলমের যে নায়কোচিত ইমেজ দাঁড় করানো হচ্ছে, এটা নিয়ে…
হিরো আলম যতই ভালো ভালো কথা বলুক, ব্যক্তিগত জীবনে হিরো আলম একজন অসৎ মানুষ। একটা মানুষের সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের আগে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করা জরুরী। পরিবারের প্রতি হিরো আলম কি দায়িত্ব পালন করে? সেটা একটা পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু অংশ তুলে দিলে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে –
হিরো আলমের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “ওর বাবা আহম্মদ মারা গেলে আমি আশরাফুন বেগমকে বিয়ে করি। এরা তিন বোন ও এক ভাই। নিজের ছেলেমেয়ের মতই তাদের মানুষ করেছি। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। আলমের ডিসের ব্যবসা আছে। এই ব্যবসাটি মূলত সে নিজেই দেখাশোনা করে। আলম ইচ্ছা মত টাকা উড়ায়। মিউজিক ভিডিও বানানোর নামে রাতদিন পরে থাকে নানা জায়গায়। বাড়িতে বাবা মা, স্ত্রী সন্তানদের কোনো খোঁজ রাখে না।”
‘কিন্তু চাচা আপনার ছেলে তো অনেক বড় সেলিব্রেটি। ইউটিউবে তার ভিডিওর ভিউয়ার্স সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। তার আইডি সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৮৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন তুলেছেন।’
এসব বলতেই হিরো আলমের বাবা বলেন, “কিসের সেলিব্রেটি, কিসের ভাইরাল? এগুলা কি? হামরা তো অতো কিছু বুঝি না। বাড়ির, ছোলপোলের খোঁজ লেয় না আবার এমপির ভোট করিচ্চে। অক কাহালু নন্দীগ্রামের কে চেনে? আসলে এগলা অর ট্যাকা খাওয়ার জন্য কিছু মানুষ ভুল বুঝে অক ল্যাচা (নাচা) লিয়্যা বেড়াচ্চে।”
“আলমের মেয়ে আলোমণি জানেনা তার বাবা এখন কোথায়, কি করছে? বাড়ির তেমন কোনো খোঁজও রাখেনা সে।”
এই হলো বর্তমান মোটিভেশন স্পিকার হিরো আলমের বাস্তব চরিত্র !
হিরো আলম তার বইতে লিখেছে –
- আমি সকল বিধবা মা, পরিত্যক্ত নারী ও শিশুদের জন্যে একটা সংস্থা করে যেতে চাই, যাতে আমার মায়ের মত কারো মায়ের যেনো মাইর খেয়ে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে রাত কাটানো না লাগে।
- আমি পরিত্যক্ত সন্তান হয়ে চানাচুর বেচে, সিডি, ডিস লাইন, মিউজিক ভিডিও করে ১০-১৫টা মানুষের দায়িত্ব নিতে পারি, আপনি শিক্ষিত হয়ে কিছু পারেন না কেনো?
উপরে হিরো আলমের আলোমণির কথার সাথে মিলিয়ে দেখুন। যে নিজে তার মেয়ের খোঁজ নেয় না, সে আবার সমাজের অসহায় নারীদের উদ্ধারের গল্প বলে বেড়াচ্ছে। যে হিরো আলম বলছে ১৫-২০ জন নারীর দ্বায়িত্ব নিয়েছে। সে তার নিজের সন্তানেরই দায়িত্ব পালন করেনা !
হিরো আলম তার বইতে আরো লিখেছে –
- আমি হিরো আলম আমার ভিডিও দেখে খালি মানুষ হাসবে এই জন্যেই কাজ করি। আমার মাইনসের হাসিমুখ দেখতেই ভালো লাগে। এই সব ভাইরাল, সমালোচনা এসবের জন্যে কাজ করি না।
অর্ধ উলঙ্গ মেয়েদের শরীর প্রতেকটি বাক জুম করে দেখিয়ে যদি মানুষকে খুশি করে সমাজের প্রতি বিরাট দায়িত্ব দেখিয়ে ফেলে, তাহলে পর্ন ইন্ড্রাস্ট্রিকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার দাবী তারা করতেই পারেন, যারা এই কার্টুনের কাছ থেকে মোটিভেশন নিচ্ছেন।
হিরো আলমের প্রতি আমার রাগ-বিদ্বেষ-হিংসা কিছুই নেই। হিরো আলমের মত গুরুত্বহীন সস্তা জোকারের জোকারি দেখে আমার হাসিও আসেনা। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। আমার কাছে হিরো আলম একজন অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু যারা হিরো আলম থেকে মোটিভেশন নিচ্ছে, তাদের অনেকেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমার পরিচিতদের মধ্যেই এরকম কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে হতাশ হয়েছি। এত এত বোকার মাঝে আমি জীবনের এত্তগুলো সময় কাটিয়ে দিলাম। বুঝতেই পারলাম না !
এভাবে পিছনের দিকে যদি একটা প্রজন্ম দৌঁড়াতেই থাকে। তাহলে একটু মন খারাপ আর হতাশা তো লাগেই৷ আমাদের কি মোটিভেশনের এতই অভাব পরেছে যে হিরো আলমের কাছেই দৌঁড়াতে হচ্ছে !