যদি ভেবে থাকেন ভারতীয়রাই প্রথম গো-মূত্র পান করেছে, তাহলে তাহলে আপনার ধারণা ভুল। ইতিহাস বলে, ভারত নয়, সর্বপ্রথম গো-মূত্র পান করা শুরু করেছিলো রোমানিয়ানরা ! ভারতীয়রা কেনো গো-মূত্র পান করেন, তা জানার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক, কখন কোথায় এবং কেনো গো-মূত্র পান করার প্রথাটা শুরু করা হয়…
রোমানিয়ানদের হাত ধরেই শুরু হয় প্রথমবারের মত গো-মূত্র পান করা। রোমানিয়ানরা আসলে গো-মূত্র ব্যবহার করত দাঁত পরিষ্কারের জন্য। একবার এক রোগাক্রান্ত রোমানিয়ান ব্যক্তি গো-মুত্র দিয়ে দাঁত মাজতে গিয়ে অসাবধানতা বশত কিছুটা গিলে ফেলেন। পরদিন তিনি বুঝতে পারেন, তার অসুখ সেরে গেছে ! এটা জানাজানি হবার পর একটা সময় তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, গো-মুত্র পাকস্থলী পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এখানে ওসব রোমানিয়ানদের কথা বলা হচ্ছে, যারা আধুনিকতার বাইরে ছিলো !
তবে গো-মূত্র পান করার কথা বললে সবার আগে চোখের সামনে ভেসে আসে ভারতের নাম। যেখানে গো-মূত্র পানের জন্য আন্দোলন হয়। শুধু তাই নয়, ভারতে গো-মূত্রের এত চাহিদা যে, বোতলে করে গো-মূত্র বিক্রি করা হয়। এটা শুধু ভারতেই নয়, ভারতের বাইরে যেখানেই ভারতীয়রা বসবাস করে, সেখানেই গো-মূত্রের চাহিদা এবং দাম অনেক। ভারতের বিজ্ঞানীরা দাবী করেছে, গো-মূত্র পান করা শরীরের জন্য উপকারী।
এমনকি আধুনিকতার আঁতুড়ঘর লন্ডন শহরেই বিক্রি হয় গো-মূত্র। এরকম একটা দোকানের একজন কর্মকর্তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। তিনি বললেন, “আমরা এটি রাখি কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে আসেন এটি কিনতে। এটি তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণের সাথে জড়িত। একটি হিন্দু পরিবারে একটি শিশু জন্মের পর যে পূজা করা হয়, সেই পূজা অনুষ্ঠানে শিশুটির ‘শুভকামনায়’ অনেকে এই গো-মূত্র ব্যবহার করেন”।
লন্ডনের আরো যেসব দোকানে এই ‘গো-মূত্র’ বিক্রি হয়, সেখানে দেখা যাবে বোতলের লেবেলের গায়ে হিন্দি ভাষায় লেখা যে এটি ‘গো-মূত্র’ এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যেই এটি বিক্রি হয়। (সূত্র : বিবিসি)
এসব দোকানে গো-মূত্র কিনতে আসা অনেকেই বলেন, “আমরা বুঝিনা গরুর লেজ, দুধ ও জিহ্বা খেলে যদি কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে মূত্র খেলে সমস্যা কোথায় !”
তবে ভারতে গরু ভক্তি সু-প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে৷ অতি সুপ্রাচীনকাল হতে ভারতবর্ষের অনেক রাজা-মহারাজার গো-পালন করতেন। মহাভারতে বর্ণিত, বিরাট রাজার ষাট হাজার গাভী ছিল। কে কত বেশী ধনশালী ও সমৃদ্ধশালী তা ঐ রাজ্যের গোশালা ও গরুর সংখ্যার উপর নির্ভর করতো। আইন-ই-আকবরী পাঠে জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবরেরও শতশত গাভী ও বলদ ছিল। তিনি মুসলমান হয়েও ভারতবর্ষে গোহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। অতীতে রাজা-মহারাজারা যে দান-ধ্যান করতেন, তার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল গোদান। গো-দানকে এখনো অবধি হিন্দু সমাজে বিশেষ পুণ্যকাজ বলে মনে করা হয়।
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বহু মত পথ, শাখা, উপশাখা ও সম্প্রদায় বিভক্ত থাকলেও কেহই গোজাতির মহত্ত্ব ও পবিত্রতার বিষয়ে অস্বীকার করেনা। “বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, স্মৃতি সকল শাস্ত্রে গো-জাতির প্রতি অসাধারণ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। বৃহৎপরাশর স্মৃতিতে গো-জাতির মহত্ত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে– গরুকে স্পর্শ করলে পাপ দূর হয়, গরুর সেবা করলে বিত্তলাভ হয়, গো-দান করলে স্বর্গলাভ হয়। গরুর মস্তকে ব্রহ্মা, স্কন্ধে শিব, পৃষ্ঠে নারায়ণ এবং চরণে বেদসমূহ অবস্থান করেন। গাভীর লোমে অন্যান্য দেবতারা অবস্থান করেন। গরু সর্বদেবময় এবং গরুর প্রতি ভক্তি করলে হরি তুষ্ট হন। তাই গরুর সেবা করলে সকল দেবতা তুষ্ট হন। গরু অষ্টমঙ্গলের অন্যতম (অষ্টমঙ্গল: ব্রাহ্মণ, গরু, অগ্নি, স্বর্ণ, ঘৃত, সূর্য, জল, রাজা)। গরুকে দর্শন, নমস্কার, অর্চনা ও প্রদক্ষিণ করলে আয়ু বৃদ্ধি হয়। ব্রহ্মপুরাণে বলা হয়েছে, গাভীকে প্রদক্ষিণ করলে সপ্তদ্বীপা পৃথিবী ভ্রমণের ফল হয়। বিষ্ঞু পুরাণ মতে গরুর মল, মূত্র, ক্ষীর, ঘৃত, দধি ও রোচনা পরম পবিত্র ও বহুগুণযুক্ত”।
একারণে সনাতনী সংস্কৃতিতে (১) গরু, (২) সংস্কৃত ভাষা (দেবভাষা) ও গীতা – এ তিনটি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বলা হয়ে থাকে ভগবান বিষ্ণর বাহন গোমাতা (গাভী)। অন্যদিকে শিবের বাহন বৃষ (ষাড়), মূলতঃ একারণেই গরুকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। শাস্ত্রীয় মতে দুগ্ধবতী গাভীকে মনে করা হয় ‘মাতরঃ সর্বভূতানাং গাবঃ সর্বসুখপ্রদাঃ’ অর্থাৎ সর্বভূতের মাতা বলে। চৈতন্যদেব গরু বিষয় বলেছেন – ‘গো দুগ্ধ খাও তাই গাভী তব মাতা। বৃষ অন্ন উপজায় তাহে তেহ পিতা’।
ভারতীয়রা আরো মনে করেন, পৃথিবীতে সম্ভবত গো-জাতিই একমাত্র প্রাণী যা খায় ঘাস, দেয় দুধ। মল ও মুত্র ত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃতিতে তথা আমাদেরকে দেয় জৈব সার ও জীবানু নাশক উপাদান। সম্ভবতঃ একসঙ্গে এধরনের একাধিক উপযোগীতা পৃথিবীর অন্য কোন পশুকুলের মধ্যে দেখা যায় না। কৃষি সভ্যতার শুরু থেকে গরুই একমাত্র প্রানী যা মানুষকে কোটি কোটি বছর অবধি চাষের ভূমি কর্ষন করে সহজে অধিক ফসল ফলাতে সাহায্য করেছে। চাকা সভ্যতা শুরু হবার পর পন্য পরিবহনের কাজে সাহায্য করেছে। বলা হয়ে থাকে, গরুর দুধ মাতৃ দুগ্ধের পরিপূরক, অর্থাৎ অকালে মাতৃহীন মানব শিশুর জীবন রক্ষায় গরুর দুধের সমকক্ষ কিংবা বিকল্প আজ অবধি নেই । পৃথিবীতে যত রকম মিষ্টি জাতীয় ও সহজপাচ্য খাদ্য সামগ্রী তৈরী হয়।
এরই মধ্যে গরুর মূত্র বা গো-চনা খেলে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা হয়, এটা বিশ্বাস করেই কিছু সংখ্যক ভারতীয়রা বহুবছর ধরে গো-মূত্র পান করে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে তারা কুমারী গাভীর মূত্র পান করে৷ তারা বিশ্বাস করে যে, কুমারী গাভীর মূত্র পবিত্র, এবং তাদের জন্য অনেক উপকারী।
এভাবে গো-মাতার অনুসারীরা মনে করেন, গরুকে স্পর্শ করলে পাপ দূর হয়, গরুর সেবা করলে বিত্তলাভ হয়। গো-দান করলে স্বর্গলাভ হয়। গরুর মস্তকে ব্রহ্মা, স্কন্ধে শিব, পৃষ্ঠে নারায়ণ এবং চরণে বেদ সমূহ অবস্থান করেন। গাভীর লোমে অন্যান্য দেবতারা অবস্থান করেন।