হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ শুধু সেনাপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন না। এসব ভারী ভারী ক্ষমতার ওজনকে ছাপিয়ে এরশাদ হয়ে উঠেছিলেন একজন প্রেমের কবি ও একজন প্রেমিক। শুধু প্রেমিক না, এরশাদকে বহুগামী প্রেমিক বললেও ভুল হবে না।
এরশাদের কবিতা লেখা নিয়েও আছে ব্যাপক বিতর্ক। অভিযোগ আছে, প্রয়াত বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন প্রমুখ ভাড়ায় এরশাদের কবিতা লিখতেন। তাদের রোমান্টিক ও যৌন কবিতা পত্রিকায় ছাপা হত এরশাদের নামে। এরশাদের পরকীয়া কাহিনী তৎকালীন ‘সাপ্তাহিক যায় যায় দিন’ পত্রিকায় ছাপা হয়।
মেয়েদের সঙ্গে তার দহরম মহরম প্রেম নিয়ে এরশাদ নিজেই বলেছেন – “আমি কোন মেয়ের কাছে যাই না। মেয়েরাই আমার নিকট আসে। মূলত: আমার চেহারা আর অভিব্যক্তির মধ্যেই এক ধরনের প্রেমিক প্রেমিক ভাব আছে”।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রেমিকার লাইন ছিলো অনেক লম্বা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা মারফত যতদুর জানা যায়, এরশাদের প্রেমিকার তালিকায় ছিলেন শাকিলা জাফর, বিদিশা, মেরি, নাশিদ কামাল, জিনাত মোশাররফ, নীলা চৌধুরী, সালমা বিন হেনা, আমেনা বারী প্রমুখ।
এরশাদ ১৯৯৭ সালে জেল থেকে বের হওয়ার পর সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’ সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, ‘তিনি কি জিনাত মোশাররফ?’ জবাবে এরশাদ বলেন, ‘অফকোর্স, তোমরা আমার ছেলের মত। তার নামটা লিখো না প্লিজ !’
ক্ষমতায় থাকাকালে জিনাতের সঙ্গে এরশাদের পরকীয়া কাহিনী ছিলেন অনেকের মুখে মুখে। তার নামের সঙ্গে মিল রেখে জিনাত মোশাররফ নতুন নামকরণ করেছিলেন জিনাত হুসেইন ! তার সঙ্গে পরকীয়া নিয়ে দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক রাশেদ আহমদের কাছে খোলামেলা সাক্ষাৎকার দেন এরশাদ। এতে ঘর ভাঙ্গে জিনাতের। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় সাবেক মন্ত্রী মোশারফের সঙ্গে। আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে এরশাদের ইচ্ছায় সংরক্ষিত আসনে মহিলা সংসদ সদস্য হন জিনাত। জিনাত মোশাররফ বর্তমানে স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করছেন। এরশাদের সাথে এখন আর তার যোগাযোগ নেই।
এরশাদের আলোচিত আরেক প্রেমিকা কণ্ঠশিল্পী শাকিলা জাফর বা শাকিলা শর্মা ! এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে একপর্যায়ে বিটিভির পর্দা দখলে থাকত তার। এরশাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু হত তার গান দিয়ে। ১৯৮৩ সালে বিটিভির ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানে ‘তুলা রাশির মেয়ে’ গানটির মাধ্যমে শাকিলার পরিচিতি ঘটে দর্শক, শ্রোতাদের সঙ্গে। এরশাদ সরকারের পতনের পর তিনি বেশ কয়েকবছর আত্মগোপনে ছিলেন। শাকিলা শর্মা প্রথমে মান্না জাফরকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তার নামের সাথে “জাফর” যুক্ত হয়। এই দম্পতির একটি সন্তান আছে। কিন্তু শাকিলা শর্মা ও মান্না জাফরের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এর দীর্ঘদিন পর শাকিলা শর্মা ভারতের মুম্বাই শহরের একজন কবি রবি শর্মাকে বিবাহ করেন। বিয়ের পর তার নাম হয় শাকিলা শর্মা। তিনি এখন ব্যস্ত আছেন সঙ্গীতচর্চা নিয়ে।
এরশাদের আরেক প্রেমিকা নাশিদ কামাল সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে। এরশাদের সাথে সম্পর্কের অবনতির পর ক্যাপ্টেন মুসাকে বিয়ে করেন। তবে বিয়েটি টেকেনি। মুসা ও নাশিদ কামালের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায। নাশিদ কামাল এখন টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। তিনি নর্থ সাউথ ইউনির্ভিসিটিতে শিক্ষকতাও করেন।
এরশাদের আরেক প্রেমিকা মেরি। লন্ডনি এ সুন্দরী গতবছর লন্ডনে মারা গেছেন। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমান তার সাপ্তাহিকের মাধ্যমে এরশাদের মেরিকে বিয়ে করার বিষয়টি সবিস্তারে সামনে নিয়ে আসেন। তাদের বিয়ের তথ্য প্রমাণসহ প্রকাশিত সংবাদের কারণে সাংবাদিক শফিক রেহমানকে প্রায় চার মাস জেলও খাটতে হয়।
প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরীও ছিলেন এরশাদের আলোচিত পরকীয়ার তালিকায়। বছর কয়েক আগে তার স্বামী কমর উদ্দিন চৌধুরী মারা গেছেন। তিনি এখন সিলেটে থাকেন।
প্রেম করে এরশাদ তার নিজের বয়সী শিক্ষক আবুবকর সিদ্দিকের মেয়ে বিদিশাকে বিয়ে করেন। বিদিশার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আলোচিত নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বিদিশার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়। তখন অভিযোগ উঠে, দুই বউকে দিয়ে এরশাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। রওশন রাখছিলেন ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে, আর বিদিশা রাখছিলেন তখনকার জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বিদিশা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লন্ডনে বৈঠকও করেন। এরপর বিএনপি সরকার থেকে এরশাদকে চাপ দেয়া হয়, তার দ্বিতীয় বউ বিদিশাকে তালাক দিতে। তখন এরশাদের দেয়া চুরির মামলায় জেলে যান বিদিশা, মুক্তিও পান। গত ১০ বছর ধরে দেশে অবস্থান করছেন তিনি। এরশাদের সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘শত্রুব সঙ্গে বসবাস’ নামে একটা বইও লিখেছেন বিদিশা।
এসবের মাঝে গত বছর দুই আগে আবারো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্যান্ডালে জড়ান এরশাদ। সাথী নামের এক আইনজীবীর সাথে ৮৮ বছর বয়সী এরশাদের ঘনিষ্ট ছবি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক টুইটারে। অনেকে মন্তব্য করেন সাথী এরশাদের নতুন বান্ধবী
… তবে নিজের প্রথম প্রেমিকার কথা এরশাদ নিজেই প্রকাশ করেন !
প্রথম প্রেমিকার কথা জানাতে গিয়ে আত্মজীবনীতে ‘সেই চিঠি: ভালো লাগার প্রথম অনুভূতি’ অধ্যায়ে এরশাদ বলেছেন, ওই সময় রংপুরের কারমাইকেল কলেজে বিএ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার নিজের ভাষায়, ‘আমার নিচের ক্লাসের একটি মেয়ে একদিন আমাকে একটি চিঠি লেখে। প্রতিদিন ও ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে কলেজে আসত’। (পৃষ্ঠা: ৬৫)
এরশাদ জানিয়েছেন, প্রায় ৬৬ বছর আগের সেই সময়ে ছেলেমেয়ের মধ্যে কথা বলার রেওয়াজ ছিল না। চিঠির আদান-প্রদান ছিলো অনেক দূরের ব্যাপার। বই দেওয়া-নেওয়া চলত। এরশাদের প্রথম প্রেমিকা চিঠিটি বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে দিয়েছিলেন। সাধারণ খামে করে দেওয়া চিঠির ভাঁজে ভাঁজে ছড়ানো ছিলো গোলাপের পাঁপড়ি ও বকুল ফুল। এরশাদ লিখেছেন, ‘তরুণ বয়সে কোনো মেয়ের কাছ থেকে চিঠি পেলে হৃদয়ে যে কিরকম অনুভূতি ঢেউ খেলে যেতে পারে, তা কেবল ওই সৌভাগ্যের মুহূর্তটি যাদের জীবনে এসেছে, তারাই অনুভব করতে পারেন, অন্যেরা নয়।’ – (পৃষ্ঠা: ৬৫)
এছাড়াও তৎকালীন এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে এফডিসির অনেক নায়িকাদের এরশাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হিসেবে ধরা হত। যার গভীরে গেলে হয়ত সত্য মিথ্যা দুটোই খুঁজে পাওয়া যাবে, নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে একজন অত্যন্ত আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ !