এক যুবকের গল্প বলি, যাকে ফেইসবুকে কেউ ফলো করত না। সুন্দরী মেয়েরা তো দূরের কথা, ‘অ্যালন বয় শিকদার’ বা ‘ভালোবাসার লাল গোলাপ’ নামের আইডিগুলোও তার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট না করে রেখে দিত ফলোয়ার বানিয়ে ! তিনি একদিন অতি দুঃখে তার ওয়ালে পোস্ট করেছিলেন তার এই দুর্ভাগ্যের কথা। সেই পোস্টের কমেন্টবক্সে তার এক বন্ধু তাকে তাচ্ছিল্য করে বলে, “মানুষ দিলদারের ফেক আইডি ফলো করলেও তোরে কোনোদিন ফলো করবে না !” এই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে প্রায় এক দশক, সময়ের চাকার সাথে সাথে সেই যুবকের ভাগ্যের চাকাও ঘুরেছে। আজ সেই যুবক ছেলেটা প্রাপ্তবয়স্ক লোকে পরিণত হয়েছেন এবং ফলোয়ারের দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় সব তারকাকে। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার প্রিয় আরিফ আর হোসাইন !
… বিশ্বাস করে ফেলেছেন আমার কথা ?
যদি বিশ্বাস করে ফেলেন, তাহলে আপনাকে দিয়ে যা খুশি তাই বিশ্বাস করানো যাবে। জোক এ্যপার্ট, বাংলাদেশের অনলাইন জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ আরিফ আর হোসাইন। তাকে নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন…
ফেসবুক এবং একজন আরিফ আর হোসাইন
আরিফ আর হোসাইনকে নিয়ে এই লেখার শুরুতেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা কেনো আসলো, তার কারণ হচ্ছে, এই মানুষটিকে নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা ছড়িয়ে আছে গত এক দশক ধরে। তার লেখা নিত্যদিনের ঘটনাগুলোয় মানুষ এতটাই মুগ্ধ ও বিমোহিত যে, তাকে না দেখেই ভক্তরা যে যার মত করে তার একটি অবয়ব তৈরি করে নিয়েছে ! কেউ ভাবেন আরিফ আর হোসাইন একজন ডাক্তার, কেউ ভাবেন ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ভাবেন আরিফ সাহেব ভিনগ্রহ থেকে আসা এক অদ্ভুত প্রাণী, আবার কেউবা ভাবেন আরিফ আর হোসেন কোনো মানুষই না, আশির্বাদ, জাস্ট একটা আশির্বাদস্বরুপ কিছু !
২০০৮ সালে ফেসবুকে মানুষ যখন গুডমর্নিং, গুডনাইট লিখে পোস্ট দিত আর ফুলবাগানে বসে তোলা ছবি আপলোড দিত, আরিফ আর হোসাইন তখন ভাবতেন কিভাবে এই প্লাটফর্মটাকে ভালো কাজে লাগানো যায় ! তারপর একদিন তিনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো একটি সামাজিক সমস্যা নিয়ে স্ট্যাটাস দেন। সেখান থেকেই শুরু। পথচলাটা এখন চলছে। শুরুটা একাই হয়েছিলো। তবে আজ আর তিনি একা নন। তার সাথে যোগ দিয়েছে দেশের লাখো তরুণ সহযোদ্ধা !
আরিফ আর হোসাইন বর্তমানে দেশের অনলাইন এবং অফলাইন জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের একজন। যেখানেই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, সেখানেই তিনি কিবোর্ডের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন বিগত এক দশক যাবৎ। শুধু কিবোর্ডেই নয়, নিজেকে আড়ালে রেখে মানবসেবা এবং সমাজ সংস্কারের জন্যও লড়ে চলেছেন তিনি। জনপ্রিয়তা অর্জন নয়, বরং দেশের জন্য কিছু করতে পারাটাই ছিলো সবসময় এ মানুষটার লক্ষ্য…
কে এই আরিফ আর হোসাইন, কি তার পরিচয়, কোথায় তার শুরু, কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি ইত্যাদি জানা-অজানা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সাজানো হয়েছে ছারপোকার এই প্রতিবেদন !
আরিফ আর হোসাইন এর পরিচয়
আরিফ সাহেবের পুরো নাম শাহ্ মোহাম্মদ আরিফ রেজা হোসাইন। ফেসবুকে তিনি Arif R Hossain নামে পরিচিত। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এই ব্যক্তি ১৯৯৭ সালে ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৯৯ সালে নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্যে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ব্রুক্স ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন ২০০৬ সালে। এরপর তিনি পারিবারিক রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় যোগদান করেন এবং বর্তমান অব্দি সেখানেই দক্ষতার নিদর্শন দিয়ে কর্মরত রয়েছেন।
৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার আরিফ সাহেব বাংলাদেশের অন্যতম দীর্ঘকায় মানুষ। তার বাবা এবং দুই ভাই দেশের নামকরা আর্কিটেক্ট। ব্যক্তিগত জীবনে আরিফ সাহেব বিবাহিত এবং দুই কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা।
এবার আসা যাক আরিফ সাহেবের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনের আসল কর্মকাণ্ডে। আরিফ সাহেব ছিলেন একজন শখের ফটোগ্রাফার। অনলাইন জীবনের প্রথমদিকে তিনি ফটোগ্রাফির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সবার সামনে উপস্থাপন করতেন। পরে একসময় ধীরে ধীরে তিনি লিখালিখি শুরু করেন এবং খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। এর পেছনে রয়েছে তার সুখপাঠ্য শব্দচয়ন এবং হাস্যরসের পরিমিত ব্যবহার। যেকোনো অন্যায় কিংবা অনিয়ম খুব সূক্ষ্মভাবে মজার ছলে উপস্থাপন করতে পারেন তিনি। দেশের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে অনলাইনে প্রথম তিনিই লিখতে শুরু করেছিলেন। জাভা ফোনের সে যুগে মানুষ তাঁকে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে লেখালেখি শুরু করে। বছর দুয়েকের মাঝেই তাকে অনুসরণ করে জন্ম নেয় আরো শখানেক ফেসবুক সেলিব্রেটি ! আজকের ফেসবুকের পরিবেশের সাথে ততকালীন ফেসবুকের পরিবেশে আকাশ পাতাল তফাৎ। তাই এখনকার নতুন ইউজাররা অনেকেই ব্যাপারটি বুঝবেন না। ইতিহাসের একটা বড় অংশ আপনারা মিস করে ফেলেছেন। ফ্যানবেজ তো যে কেউই বানাতে পারে। কিন্তু তরুণ, বৃদ্ধ, এলিট, ননএলিট; এক কথায় সমাজের প্রতিটা শ্রেণীর মানুষকে নিজের গল্প শোনাতে কজনই বা পারে !
আরিফ আর হোসাইন মানেই সোশ্যাল ওয়ার্ক !
দেশের প্রতি রয়েছে আরিফ আর হোসাইনের অগাধ ভালোবাসা। দেশের উন্নয়নে তরুন সমাজকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। হিউমারসমৃদ্ধ পোস্টের মাধ্যমে নিজের পজেটিভ চিন্তা-চেতনা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজের প্রত্যেকটা স্তরের মানুষের কাছে। জনদরদী এই মানুষটার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ‘কনসার্ট ফর কম্বল’। উত্তরবঙ্গ সহ দেশের প্রায় প্রতিটা অঞ্চলের শীতার্তদের মাঝে তিনি কম্বল পৌঁছে দিয়েছেন এই কনসার্ট ফর কম্বল প্রোগ্রামের মাধ্যমে। তিনি নিজে নিয়মিত রক্তদান করেন এবং অন্যদের সবসময় রক্তদানে উৎসাহিত করেন। দেশ ও সমাজের উপকার হয়, এই ধরনের যেকোনো কাজ কিংবা আইডিয়া নিয়ে কেউ তার কাছে উপস্থিত হলে কখনোই তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। আর্থিক, মানসিক কিংবা প্রমোশনাল, প্রয়োজনীয় সবধরনের সহযোগিতা তিনি করে থাকেন। এছাড়াও তিনি নিয়মিতভাবে সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করেন এবং সেগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করেন।
আমরাই বাংলাদেশ, প্রজেক্ট কম্বল, এক টাকায় আহার, দ্য টু আওয়ার জব, টয়জ আর ইওরস, প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন, প্রজেক্ট ছারপোকা, টেন মিনিট স্কুল সহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে আরিফ আর হোসাইন যুক্ত আছেন। তার এই সাথে থাকার অনুপ্রেরণা পেয়ে নানান রকমের সুন্দর সব আইডিয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত এরা কাজ করে যাচ্ছে দেশের জন্য, সমাজ সংস্কারের জন্য…
জেনে অবাক হবেন, আন্তর্জাতিক ডয়েচে ভেলে’র ববস এওয়ার্ডের জন্য বেশ কয়েকবার আরিফ আর হোসেন মনোনিত হয়েছেন। যা কিনা অনলাইন এক্টিভিস্টদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এওয়ার্ড !
ব্যক্তিগতভাবে প্রচন্ড পজেটিভ এই মানুষটা সবসময় তার চারপাশে পজেটিভিটি ছড়িয়ে দিতে চান। তিনি বিশ্বাস করেন, আমি আর আপনি মিলে আমরা হই, এবং এই আমরাই পারি আমাদের দেশ ও সমাজটাকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে…
আরিফ আর হোসাইনকে নিয়ে যত সমালোচনা
আরিফ আর হোসাইনকে নিয়ে সমালোচনা ও নিন্দা করার লোকের সংখ্যাটা তার ভক্তের তুলনায় খুবই কম। তার মতে, মানুষ সমালোচনা করতেই পারে। এতে বিরক্ত হবার কিছু নেই। নিন্দুকদেরও গ্রাহ্য করার কিছু নেই।
তবুও বলতে হচ্ছে, এই লোকটাকে নিয়ে আসলে সমালোচনা করাটা মানায় না…
না উনি কোনো রাজনৈতিক দলের লোক, না উনি দেশের উন্নতির বিপক্ষে কোনো অপশক্তি। কোনোটাই নয়। এই মানুষটি যা করছেন, যা লিখছেন, যা বলছেন, সবকিছুর পেছনে একটাই উদ্দেশ্য, দেশের মানুষ ভালো থাকুক। দেশ আরেকটু এগিয়ে যাক। তার জন্য উনাকে কোনো বিশেষ দলের লোক ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বরং বোকামির কাজ। যদি ভাবতেই হয়, “দেশপ্রেমিক” ভাবা যায়। উনি কেবলমাত্র এই দলের লোক…
ইংরেজিতে একটা কথা প্রচলিত আছে, If you’re doing something right, you have to face some critics and haters for sure ! এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে আরিফ সাহেবেরও রয়েছে কিছু নিন্দুক এবং সমালোচক। যারা প্রতিনিয়ত উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার কাজগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে থাকে। এদের সামনে কখনোই দমে যাননি আরিফ আর হোসাইন ! আর আমাদের বিশ্বাস, এদের অযৌক্তিক সমালোচনায় কখনোই বিদ্ধ হবেন না এই সমাজসেবক…
ছারপোকা পরিবারের পক্ষ থেকে আরিফ আর হোসাইনের জন্য রইলো শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, দোয়া এবং এগিয়ে যাবার শুভকামনা…