একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যেক বাঙালীর জন্য গর্ব আর অহংকারের। কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া কিছু লড়াইয়ের ঘটনা আমাদের এই গর্ব আরো অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। অনেক যুদ্ধের ঘটনার কথা আমরা জানি, আবার অনেক লড়াইয়ের কাহিনী আমাদের অজানা। শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ এমনই এক ঘটনা। যে যুদ্ধের কৌশল ভারত, পোল্যান্ড সহ ৩৫টি দেশের সেনাবাহিনীর ডিফেন্স কলেজে পড়ানো হয়। এটা কারো কাছে শিরোমণি সম্মুখ সমর নামেও পরিচিত।
আসুন জেনে নেওয়া যাক ‘শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ’ ঘটনার বিস্তারিত…
শিরোমণি’র অবস্থান
খুলনা থেকে বাসে ফুলতলা যাবার পথে শিরোমণি বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটেই সাধারণত যাওয়া যায়। এর আশেপাশে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরনো ভবন, গাছপালা লক্ষ্য করলেই আজো শিরোমণির ভয়াবহতা চোখে পড়ে !
শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ
১৬ই ডিসেম্বর সারাদেশ স্বাধীন হলেও খুলনা তখনও পর্যন্ত পরাধীন ছিল। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনী বাধ্য হয়ে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর খুলনা সদর দপ্তরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মুহম্মদ হায়াত খান পাকবাহিনীর একটা বড় ব্রিগেড নিয়ে খুলনার শিরোমণি, আটরা, গিলেতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর ও শোলগাতিয়া এলাকার একাধিক স্থানে ক্যাম্প গড়ে তোলেন। পাকিরা আত্মসমর্পন করলেও তিনি তা না মেনে যুদ্ধ চালিয়ে যান। পাকবাহিনীর আতংকতার মধ্যে জনশূন্য শিরোমনি এলাকায় কমান্ডার হায়াত খানই সবচেয়ে বড় ক্যাম্প গড়েন এবং মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা-মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে ৯ ডিসেম্বর নওয়াপাড়া (অভয়নগর) মুক্ত হয়। পরদিন ১০ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী খুলনা অভিমুখে ফুলতলা উপজেলার চৌদ্দমাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। সেখানে থেকে খুলনা মুক্ত করার কৌশল নির্ধারণের পাশাপাশি পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে ভারী অস্ত্রের গোলা বর্ষণ অব্যাহত রাখেন।
হায়াত খান তার সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ব্রিগেড নিয়ে খুলনা শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম এলাকা জুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাছাড়া আটরা থেকে শিরোমণি এলাকার যশোর রোডে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুতে বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রস্তুতি নেয়। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করেও কোনো সাড়া না পেয়ে এবং তাদের নিরবতা দেখে ভুল ধারণার বশর্বর্তী হয়ে ফুলতলার চৌদ্দমাইলে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মেজর গণির নেতৃত্বে একটা বড় কনভয় ১৪ ডিসেম্বর খুলনার দিকে রওনা করে। মিত্রবাহিনী খুলনার শিরোমনি এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রে নিশানার মধ্যে পৌঁছালে পাকবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়।
ওই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সামনে থাকা বিপুল সংখ্যক সেনা হতাহত হয়। তবে প্রচন্ড ক্ষতির পরও কিছু সংখ্যক সেনা ফুলতলার চৌদ্দ মাইল ক্যাম্পে ফিরে যান। সেখানে মিত্রবাহিনী মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর, ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল যৌথভাবে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তখন মেজর মঞ্জুর সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদাকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমন কৌশল তৈরি করেন। চক্রাখালি মাধ্যমিক স্কুল থেকে মেজর জয়নাল আবেদিন (স্বাধীনতা পরবর্তী ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) এর নেতৃত্বে গল্লামারি রেডিও সেন্টার অভিমুখে আক্রমন শুরু হয়।
রেডিও সেন্টারে নিরাপত্তার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের আগ থেকে পাঞ্জাবি সেনা মোতায়েন ছিল। অপরদিকে, মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট ইস্টার্ণ জুটমিল গেট এলাকা দিয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে শিরোমনির ঠিক পূর্বপাশে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে পশ্চিম পাশে পাক সেনাদের উদ্দেশ্যে গোলা ছুঁড়তে থাকেন। ওই সময় মেজর মঞ্জুর তার বাহিনীকে নিয়ে ১৫ই ডিসেম্বর বুধবার ও ১৬ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সারাদিন ধরে বিভিন্ন দিক থেকে খন্ড খন্ড যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে শিরোমনি অবস্থানে ঘিরে ফেলেন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও হায়াত খান তা না মেনে তার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন সেই ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট এবং চার সহস্রাধিক সৈন্য। ওই রাত থেকেই মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক সম্মুখ সমর।
শিরোমণি ট্যাংক যুদ্ধের ইতি ঘটে যেভাবে…
১৬ই ডিসেম্বর সারারাত ধরে চলা যুদ্ধে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির মুখে এক পর্যায়ে ১৭ই ডিসেম্বর ভোরে পর্যুদস্ত পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বিজয়ী মিত্রবাহিনী-মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শিরোমণি নসু খানের ইটভাটার কাছে পরাজিত পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে। ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বেলা দেড়টায় সার্কিট হাউস মাঠে লিখিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর ও ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের বেল্ট ও ব্যাজ খুলে নিয়ে আত্মসমর্পণের প্রমাণাদিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেন।
এই যুদ্ধটিকে বলা হয় ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’ বা শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ, যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর একমাত্র ট্যাঙ্ক যুদ্ধ !