ভারতে সমকামীতা বৈধতা পাওয়া বর্তমান সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের সর্বপ্রথম সমকামীতা বৈধতা পেয়েছে। এবং এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনারও শেষ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাবার আগে শুরুর ইতিহাসটা জানাও বেশ জরুরী ! তা নিয়েই ছারপোকা ম্যাগাজিন এর আজকের এই প্রতিবেদন, ভারতের সমকামী সংস্কৃতি !
সমকামীতার ইতিহাস
মানবজাতির সামগ্রিক ইতিহাসে সবসময়ই সমকামীতার অস্তিত্ব ছিলো। সমকামীদের সন্ধান মিলবে পৃথিবীর সর্বত্র, প্রতিটি যুগে প্রতিটি সময়ে কিংবা প্রতিটি স্থানেই। কোন কোন জায়গায় সমকামীতা রীতিমত উদযাপন করা হত সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই। প্রাচীন গ্রীসে পাইদেরাস্ত্রিয়া, কিংবা এরাস্তেস এবং এরোমেনোস এর সম্পর্কগুলো উল্লেখযোগ্য। সমকামীতার প্রছন্ন উল্লেখ আছে প্রাচীন বহু সাহিত্যে। হোমারে বর্ণিত আকিলিস এবং পেট্রোক্লুসের সম্পর্ক, প্লেটোর দার্শনিক গ্রন্থ সিম্পোজিয়ামে ফায়াডেরাস, পসানিয়াস, এগাথন, অ্যারিস্টোফেনেস, এরিক্সিমাচুসের নানা বক্তব্য এবং সক্রেটিসের সাথে আলকিবিয়াডসের প্লেটোনিক সম্পর্ককে বহু বিশেষজ্ঞ সমকামীতার দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করেন। খ্রীস্টপূর্ব ছয় শতকের গ্রিসের লেসবো দ্বীপের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা স্যাপো নারীদের নিয়ে, তাদের সৌন্দর্য নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। এই লেসবো থেকেই লেসবিয়ান (নারী সমকামীতা) শব্দটি এসেছে। বহু রোমান সম্রাট, যেমন – জুলিয়াস সিজার, হাড্রিয়ান, কমোডাস, এলাগাবালাস, ফিলিপ দ্য এরাবিয়ান সহ অনেক সম্রাটেরই সমকামের প্রতি আসক্তি ছিলো বলে ইতিহাসে উল্লিখিত আছে। রেনেসাঁর সময় বহু খ্যাতনামা ইউরোপীয় শিল্পী যেমন, দোনাতেল্লো, বত্তিচেল্লী, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলোর সমকাম প্রবণতার উল্লেখ আছে। চৈনিক সভ্যতা এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতেও সমকামীতার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন বিষ্ণুর মোহিনী অবতাররূপে ধরাধামে এসে শিবকে আকর্ষিত করার কাহিনী এর একটি দৃষ্টান্ত। বিষ্ণু (হরি) এবং শিবের (হর) মিলনের ফসল অয়াপ্পানকে হরিহরপুত্র নামেও সম্বোধন করা হয়। এছাড়া অষ্টাবক্র, শিখন্ডী এবং বৃহন্নলার উদাহরণগুলো সমকামিতা এবং রূপান্তরকামিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে উঠে এসেছে।
সমকামীতা বিষয়ে ভারতের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
ভারত আয়তনে বিরাট একটি রাষ্ট্র এবং নানা জাতিগোষ্ঠীর সমবায়ে গঠিত। পরিব্যাপ্ত ভারতের সমাজে সমকাম
অনৈতিক কর্ম হিসেবে বিবেচিত। সমকামীতাকে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখা হয়। সমকামীতাকে সমর্থন করে বা সমকামের বিষয়ে নির্লিপ্ত নাগরিকের সংখ্যা নগণ্য। সমকামীরা চিহ্নিত হয়ে পড়লে সমাজ তাদের হেয় দৃষ্টিতে দেখে। ভারতে সমকাম বিরোধিতা বা হোমোফোবিয়া প্রকট। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে; পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে সমকামিতা ও সমকামীদের নিয়ে আলোচনা স্থান লাভ করছে।
ভারতের যত সমকামীতা সম্পর্কিত সিনেমা
ফায়ার (১৯৯৭) : ভারতে সমকামী ছবি তৈরির পথপ্রদর্শক দীপা মেটা। তাঁর ট্রিলজির প্রথম ছবি ফায়ার। বৈবাহিক জীবনের সমস্যায় জর্জরিত দুই মহিলার শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কাহিনি নিয়ে ফায়ার ভারতে আগুন জ্বলেছিল। বক্সঅফিসে মুক্তি রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি এড়াতে পারেনি ফায়ার।
বমগে (১৯৯৬) : বমগে সমকামিতার ওপর তৈরি ভারতের প্রথম ডকুছবি বমগে। যদিও ভারতে মুক্তি পায়নি এই ছবি। কবি আর. রাজ রাওয়ের লেখার ওপর, মুম্বইয়ের গে সংস্কৃতি নিয়ে গে পরিচালক রিয়াদ ভিঞ্চি ওয়াদিয়ার ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রাহুল বোস।
ম্যাঙ্গো সুফলে (২০০২) : ৬ বছর পর ম্যাঙ্গো সুফলে বানিয়েছিলেন সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মহেশ দত্তানি। একাকিত্বে ভোগা গে ফ্যাশন ডিজাইনারের গল্প কমিক মোড়কে উপস্থাপন করেছিলেন মহেশ। ফায়ারের মতো প্রতিবাদের মুখে না পড়তে হলেও, চুপিচুপি মুক্তি পেয়ে চুপিচুপিই হল থেকে চলে গিয়েছিল ম্যাঙ্গো সুফলে।
কাল হো না হো (২০০৩) : মুম্বাইয়ের মেনস্ট্রিম ধারায় সমকামিতাকে ব্যঙ্গাত্মক রূপ দিয়েছিলেন করণ জোহর। তবে শুধু সমকামিতা নয়, সমকামিতার প্রতি মানুষের ভুরু কোঁচকানোও করণ তুলে এনেছিলেন ছবিতে। শাহরুখ ও সৈফ আলি খানের গে সম্পর্ক দেখে চমকে ওঠেন ছবির চরিত্র কান্তা বেন।
গার্লফ্রেন্ড (২০০৪) : গে সম্পর্ক নিয়ে ছবি বেশ কিছু হলেও লেসবিয়ান সম্পর্ক নিয়ে ছবি ফায়ারের পর হয়েছে গার্লফ্রেন্ড। দুই বন্ধুর মধ্যে একজন লেসবিয়ান, অন্যজন বাইসেক্সুয়াল। বন্ধুর সঙ্গে সমকামিতার সম্পর্ক ছাড়াও তাঁর জীবনে ছিল প্রেমও। সমকামিতার সম্পর্ক ও স্ট্রেট সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, বয়ফ্রেন্ড ও বন্ধুর মধ্যে যৌন হিংসা, নিয়ে এগিয়েছে গার্লফ্রেন্ডের গল্প।
মাই ব্রাদার নিখিল (২০০৫) : প্রথম ছবিতেই গে সমকামিতাকে দারুণ সফলভাবে নিয়ে এসেছিলেন গে পরিচালক ওনির। ভারতের মতো দেশে থেকে সমকামিতার কারণে একঘরে হয়ে যাওয়া থেকে এইডস নিয়ে বাঁধাধরা ধারণা, সর্বোপরি পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, সবকিছুই ওনির তুলে ধরেছিলেন ছবিতে। পরে আই অ্যাম ছবিতেও !
হানিমুন ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড (২০০৭) : ছটি সদ্যবিবাহিত জুটির হনিমুনের গল্পো। এই ছয় জোড়ার মধ্যেই ছিলেন সমকামী সদ্য বিবাহিত এক পুরুষ। কীভাবে সেখান থেকেই অন্য সমকামী পুরুষের প্রতি আকর্ষণ ও বৈবাহিক সম্পর্কেও নিজেদের নিজেদের পছন্দের জায়গা বেছে নেন তাঁরা।
দোস্তানা (২০০৮) : পাঁচ বছর আবার একই বিষয় রুপোলি পর্দায় নিয়ে আসেন করণ জোহর। অভিষেক বচ্চন আর জন আব্রাহামের সাজানো গে সম্পর্ক বক্সঅফিসে প্রথমবারের জন্য কিছুটা হলেও দর্শকদের আনুকূল্য পেয়েছিল। পরে বম্বে টকিজ ছবিতেও সমকামিতা দেখিয়েছেন করণ।
ফ্যাশন (২০০৮) : ফ্যাশন ছবিতে সমকামিতার অন্য দিক তুলে ধরেন মধুর ভান্ডারকর। সমাজের সামনে নিজের সমকামিতা লুকিয়ে রাখতে বন্ধু মুগ্ধা গডসেকে বিয়ে করেন গে ডিজাইনার সমীর সোনি।
ডোননো হোয়াই, না জানে কিউ (২০১০) : তিন বছর আগেও সমকামিতা নিয়ে ছবি ডোননো হোয়াই…না জানে কিঁউ কে সেন্সরবোর্ডের চোখরাঙানির মুখে পড়তে হয়েছে। এমনকী, সমকামিতার দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য অভিনেতা যুবরাজ পরাশরকে ত্যাজ্য করেছিল তাঁর পরিবার।
ভারতের বিখ্যাত সমকামী যারা
করণ জোহর : বলিউডে বিভিন্ন জায়গা থেকেই কানাঘুষো শোনা যায় যে পরিচালক করণ জোহর সমকামী। তাঁর সঙ্গে ডিজাইনার মণীষ মালহোত্রার বন্ধুত্ব নিয়েও একটা সময় বিস্তর জল ঘোলা হয়। যদিও সমকাম নিয়ে নিজে কোনো দিনই মুখ খোলেননি করণ।
বিক্রম শেঠ : বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিক্রম শেঠও নিজেকে সমকামী বলে দাবি করেছেন। ফলে তাঁর সম্পর্কে কোনও গুঞ্জনের অবকাশ রাখেননি তিনি।
ভিজে অ্যান্ডি : ভিডিও জকি অ্যান্ডিও নিজেকে সমকামী বলে দাবি করেন। ‘ডেয়ার টু ডেট ‘ খ্যাত এই ভিজে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে খবরের শিরোনাম কেড়েছেন।
মণীষ আরোরা : ডিজাইনার মণীষ আরোররা সম্পর্কেও এমন কথা রটে যে তিনিও নাকি সমকামী. যদিও মণীষ আরোরা নিজে এনিয়ে কোনও কথা বলেননি।
রোহিত বাল : ডিজাইনার রোহিত বাল সম্পর্কেও এমন তথ্য শোনা যায় , যে তিনি সমকামী। বিষয়টি রোহিত নিজেও স্বীকার করে নেন।
ববি ডার্লিং : ববি ডার্লিংকে নিয়ে বলিউড বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিতর্ক দানা বেঁধেছে। পঙ্কজ শর্মা ওরফে ববি ডার্লিং সেক্স চেঞ্জ করানোর পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনামে আসেন।
ইমাম সিদ্দিকি : ডিজাইনার ইমাম সিদ্দিকি সম্পর্কেও এমন তথ্য বহু বার উঠে এসেছে। অনকেই তাকে সমকামী বলে চিহ্নিত করেছেন। এরপর বিগবস ৬ – এ ইমাম নিজেই জানিয়েছেন যে তিনি সমকামী।
সমকামীতা কি ?
সমকামীতা (Homosexuality) একটি যৌন প্রবৃত্তি, যার দ্বারা সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ বোঝায়। এইরূপ আকর্ষণের কারণে সমলিঙ্গীয় মানুষের মধ্যে প্রেম বা যৌনসম্পর্ক ঘটতে পারে। প্রবৃত্তি হিসেবে সমকামিতা বলতে বোঝায় মূলত সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি “এক যৌন, স্নেহ বা প্রণয়ঘটিত এক ধরনের স্থায়ী ও প্রাকৃত প্রবণতা”। এই ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিচিতি, এই ধরনের আচরণ এবং সমজাতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এক সম্প্রদায়ের সদস্যতাও নির্দেশিত হয়।”
সমকামিতা’র ইংরেজি প্রতিশব্দ হোমোসেক্সুয়ালিটি তৈরি হয়েছে গ্রিক ‘হোমো’ এবং ল্যাটিন ‘সেক্সাস’ শব্দের সমন্বয়ে। গ্রিক ভাষায় ‘হোমো’ বলতে বোঝায় ‘সমধর্মী’ বা ‘একই ধরণের’। আর সেক্সাস শব্দটির অর্থ হচ্ছে যৌনতা। কাজেই একই ধরনের অর্থাৎ, সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার (যৌন) প্রবৃত্তিকে বলে হোমোসেক্সুয়ালিটি। বাংলায় ‘সমকামিতা/সমকামীতা’ শব্দটি এসেছে বিশেষণ পদ ‘সমকামী’ থেকে। আবার সমকামী শব্দের উৎস নিহিত রয়েছে সংস্কৃত ‘সমকামিন’ শব্দটির মধ্যে। যে ব্যক্তি সমলৈঙ্গিক ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তাকে ‘সমকামিন’ বলা হত। সম এবং কাম শব্দের সাথে ইন প্রত্যয় যোগ করে ‘সমকামিন’ (সম + কাম + ইন্) শব্দটি সৃষ্টি করা হয়েছে।
তথ্য উপাত্তে ভারতে সমকামীতা
- সমলৈঙ্গিক অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা মোট জনসংখ্যার ২% থেকে ১৩%।
- ১৬৩ বছর আগে ব্রিটিশ ভারত সমকামীতাকে অপরাধ বলে গণ্য করেছিল৷ তার আগে পর্যন্ত সমকামিতা নিয়ে ভারতীয় সমাজে সে ভাবে কোনও হেলদোল ছিল না।
- ২০০৯ সালের ২ জুলাই, দিল্লি হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয় সমকামীতা কোন অপরাধ নয়।
- ২০১৩ সালে পুনরায় সমকামিতাকে অবৈধ ঘোষণা করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
- ধর্ম হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলিতে সমকামিতার সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও, ধর্মগ্রন্থের কোনো কোনো ব্যাখ্যাকে সমকামিতার বিরোধী মনে করা হয়।
- ভারতে সমকামিতার উপর থেকে অপরাধ আরোপত্ব অপনয়নে যেসকল সংস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে সেগুলি হল ন্যাজ ফাউন্ডেশন (ভারত), জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রক সংস্থা [১৩], ভারতের আইন কমিশন [১৪], ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক [১৫], জাতীয় মানবাধিকার কমিশন [১৬], ও ভারতের পরিকল্পনা কমিশন [১৭], এই সকল সংস্থা।
- ১৮৬০ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে সমকামকে প্রথম আইনগতভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীন হলে এই আইন বলবৎ ও কার্যকর থাকে।