যে কারণে নোয়াখালীকে ট্রল করা উচিত নয়

‘আঙ্গুবাড়ি নোয়াখালী রয়েল ডিষ্ট্রিক ভাই, সেনবাগ মাইজদী চৌমুহনী নাম হুইঞ্চোনি তোমরা ভাই?’ শুনে কি মনে হচ্ছে? আঞ্চলিক, বহুল পরিচিত নোয়াখালির একটা গান। আদৌ কি গানটাতে ট্রল করার মত কিংবা সার্কাজমের কোনো উপাদান আছে? উত্তর জানা সত্ত্বেও অজানা। কিন্তু জানা অজানার এই প্রশ্নের ভিড়ে আমরা কি জানি নোয়াখালিকে কেনো ট্রল করা হয়? কেনোই বা তাদের নিয়ে ট্রল করা উচিত নয়? চলুন নোয়াখালীর এই ট্রল হওয়া সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক….

নোয়াখালীকে নিয়ে ট্রলের কারণ

নোয়াখালীকে ট্রলের কোনো পোক্ত কারণ নেই বললেই চলে। ট্রল করার জন্য আমাদের দেশের মানুষেরা পোক্ত কারণের সন্ধানী কখনোই নয়। বিষয় পেলেই সেটা নিয়ে ট্রল করা শুরু করা আমাদের চিরায়ত স্বভাব। তবে বহুল শ্রবনীয় যেসব উল্ল্যেখযোগ্য কারন পাওয়া যায় সেগুলো হলো…

  • ব্রিটিশ আমলে দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে নোয়াখালীতে থাকা ইমাম-হুজুরগণ নাকি প্রতারণার মাধ্যমে কিছু জমি দখল করে নিয়েছিলো। সেই থেকে তাদের সম্পর্কে সবার একটা খারাপ ধারণা এসে যায় এবং মানুষ নোয়াখালীকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা আরম্ভ করে।
  • দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে নোয়াখালীর লোকেরা নিজেদের এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। (লালসালু)
  • নোয়াখালীর মানুষের অদ্ভুত ভাষা এবং তারা নিজেই নিজেদেরকে নোয়াখাইল্ল্যা বলাটাও ট্রলের শিকার হবার একটি কারণ বলা যেতে পারে। তারা ‘প’ কে বলে ‘হ’। পানিকে বলে ‘হানি’। এইসব ছোটখাট ভাষাবিভ্রাট অনেকের হাসির উদ্রেক ঘটায় যা ট্রলে উৎসাহিত করে, যদিও তা অনুচিত।
  • ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতেও এ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়। সে দুঃসময়ে মহাত্মা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী শান্তির বার্তা নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে নোয়াখালীতে আসেন। ১৯৪৭ সালের ৭ নভেম্বর গান্ধীজি নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনী রেলস্টেশনে পদার্পন করে রেলওয়ে ময়দানে প্রথম জনসভা করেন। নোয়াখালীতে গান্ধীজি আসার সময় একটি ছাগল নিয়ে এসেছিলেন। আর নোয়াখালীর মানুষজন নাকি তার ছাগল চুরি করে খেয়ে ফেলেছিলো ! এজন্যও অনেকে নোয়াখালীকে ট্রল করে।
  • নোয়াখালী বিভাগ চাই’, ‘কুমিল্লাকে বিভাগ করা হলে মুতে ভাসিয়ে দিবো’ এরকম বিভাগ চাওয়া সম্পর্কিত হাজারো ট্রলে বিধ্বস্ত হয়েছিল নোয়াখালী। মূলত তাদের যৌক্তিক দাবীতে মানুষ ট্রল করতে উঠেপড়ে লেগেছিলো। এ কারন মূলত পূর্বের ঘটনাবলী।

যে কারণে নোয়াখালিকে ট্রল করা উচিক নয়

হাজারো উদাহারন দেয়া সম্ভব যেসব কারণে নোয়াখালীকে ট্রল করা উচিত নয়। উল্ল্যেখযোগ্য কারণগুলা দেখে নমনেয়া যাক একপলকে…

নোয়াখালী নামকরণ : নোয়াখালীর নাম নিয়ে ট্রল করা হয় কিন্তু অনেকেই জানেন না নোয়াখালী নামকরনের ইতিহাসই ! জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। ১৮২১ সালে নোয়াখালী ভুলুয়া জেলা নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬৮ সালে এ জেলার নোয়াখালী নামকরণ হয়। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। ইতিহাসবিদদের মতে একবার ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় “নোয়া (নতুন) খাল” বলা হত, এর ফলে অঞ্চলটি একসময়ে লোকের মুখে মুখে পরিবর্তিত হয়ে “নোয়াখালী” হিসাবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। দেশের সবচেয়ে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এলাকার একটি হলো নোয়াখালী

নোয়াখালীর বিখ্যাত মানুষজন : বিখ্যাত অনেক মানুষজন নোয়াখালীর সন্তান। যাদের সংখ্যা দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বেশী। দেশের প্রথম নারী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, শহীদ বুদ্ধিজীবি মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শিক্ষাবিদ মোতাহের হোসেন চৌধুরী, সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মধ্যযুগীয় কবি আব্দুল হাকিম, অনুবাদক কবীর চৌধুরী, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবি মুনীর চৌধুরী থেকে শুরু করে হালের তাহসিনেশন সহ আরো অনেকেই নোয়াখালীর কৃতি ব্যাক্তিত্ব।

নোয়াখালীর প্রাকৃতিক যত সৌন্দর্য : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়েও নোয়াখালী অনন্য। সৌন্দর্যে অন্যন্য জেলার থেকে কম তো নয়ই বরং অনেক বেশী সৌন্দর্য, ইতিহাস, প্রকৃতিতে ভরপুর বটে নোয়াখালী। দার্শনীয় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্থানের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক কমলা রাণীর দিঘী, গান্ধী আশ্রম, হরিণে ভরপুর নিঝুম দ্বীপ, ফকির ছাড়ু মিজি (রহ‍ঃ) সাহেবের দরগাহ, বজরা শাহী মসজিদ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, সোনাইমুড়ি মহাত্মা গান্ধী জাদুঘর, মাইজদী কোর্ট বিল্ডিং দীঘি, মাইজদী ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, চর জব্বার, স্বর্ণ দ্বীপ ইত্যাদি।

দেশ গড়ায় নোয়াখালীর অবদান

দেশের মোট আয়ে নোয়াখালীর রয়েছে অনন্য অবদান। আয়ের উৎসগুলোর মধ্যে অ-কৃষি শ্রম ৩.৪৩%, শিল্প ০.৮৪%, বাণিজ্য ১৪.৭৪%, পরিবহন খাত ৩.৮৩%, চাকুরি ১৬.১১%, নির্মাণখাত ১.৪৯%, রেমিট্যান্স ৮% এবং অন্যান্য ১০.৫৮% অবদান রাখছে নোয়াখালী জেলা।

শিক্ষার হার

নোয়াখালির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড় শিক্ষিত মানুষের হার হার ৫১.৭%; পুরুষ ৫৩.৫%, মহিলা ৪৯.৯%।
দেশের অনেক জেলার শিক্ষার হার যেখানে ৩০-৪০%! এছাড়াও ২০টিরও বেশী পত্রিকা নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত হয়!

বৈদেশিক খাতে নোয়াখালীর অবদান

গত দশ বছরে নোয়াখালী থেকে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে গিয়েছে প্রায় ৩ লাখ মানুষ। দেশের সর্বাধিক রেমিটেন্স পাঠানো ২৯ জেলার মধ্যে সর্বাধিক ৯% রেমিটেন্স পাঠায় নোয়াখালীর লোকেরা !

নোয়াখালীর ভাষা

আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে যদি ট্রল হয় তাহলে চট্টগ্রাম, বরিশাল নিয়ে ট্রল হবে না কেন? তাছাড়া বৃহত্তর কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে !

পরিশেষে

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় নোয়াখালীতে উপস্থিত হয় হাজারো শিক্ষারর্থী। যাদের থাকার জায়গা কিংবা খাবার দেয়ার মত সামর্থ্য হোটেল, রেস্টুরেন্টগুলোর থাকে না। কিন্তু নোয়াখালীর মানুষজন তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে প্রতিবছর ! এরপরও কি নোয়াখালীকে নিয়ে ট্রল করবেন? নাকি আরেকবার ভাববেন? প্রশ্ন রইলো বিবেকের কাছে…