“বিজ্ঞান এতটাই অনিশ্চিত হবে আগে জানলে বিজ্ঞানী হতাম না, হতাম সরাইখানার বেয়ারা নয়তো ফুটপাতের মুচি!” -অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যার সমাধান করতে গিয়ে এমনকী আইনস্টাইনও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ ঘটনা বটে, দুর্ঘটনাই বলা চলে। আর এই দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটে জার্মান বিজ্ঞানি ম্যাক্স প্লাঙ্কের হাত ধরে।
7 অক্টোবর, সাল 1900
ম্যাক্স প্লাঙ্ক তখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। হেনরিখ রুবেন্স তাঁর গবেষণা সহকর্মী।
ওই দিন রুবেন্স আর তাঁর স্ত্রী বেড়াতে আসেন প্লাঙ্কের বাড়িতে। সেখানেই রুবেন্স জানান, কৃষ্ণবস্তর বা কালো রঙের বস্তুর বিকিরণের একটা পরীক্ষার কথা। পরীক্ষায় কী ফল পেয়েছেন তাও বলেন। আসলে সমস্যাটা ছিল বিকিরণ-সংক্রান্ত।
আদর্শ কৃষ্ণবস্তু বা ঘোর কালো রঙের কোনো বস্তু তার উপর পড়া সবটুকু আলো আর তাপ শক্তি শোষণ করে নেয় (যে কারণে আমরা এসব বস্তুকে রঙহীন বা কালো দেখি)।
শোষণ করে নেওয়ার পর কৃষ্ণবস্তুটি আলোকরশ্মি বিকিরণ করে। কিন্তু সেই বিকিরণপ্রক্রিয়া মেনে চলে না তখনকার পদার্থবিজ্ঞানের দুটি চিরায়ত গতিতত্ব। একটা নিউটনের গতিতত্ব এবং অন্যটি ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎগতিবিদ্যা।
এছাড়া অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী লুডভিক বোলজম্যান, জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম ভিন এবং দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড রেলে ও জেমস জিনস প্রত্যেকে বিভিন্ন সূত্র উপস্থাপন করেন কিন্তু কোনোটাই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে নি।
রুবেন্স প্ল্যাঙ্ককে বলেন, দীর্ঘ তরঙ্গের বিকিরণের ব্যাখ্যা উইলহেম ভিনের সূত্র দিয়ে করা যায় কিন্তু ক্ষুদ্র তরঙ্গে তা অচল।
আবার লর্ড রেলে ও জেমস জিনসের সূত্র দিয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গের বিকিরণ ব্যাখ্যা করা গেলেও দীর্ঘ তরঙ্গের ব্যাখ্যায় তা যায় না। অর্থাৎ, দীর্ঘ এবং ক্ষুদ্র উভয় তরঙ্গের ব্যাখ্যার জন্য একইসাথে দুটি সূত্রই প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হলো সূত্র দুইটা পরস্পরবিরোধী! (পয়েন্ট টু বি নোটেড)
সন্ধ্যায় রুবেন্স ও তাঁর স্ত্রী বাসায় ফিরে গেলে প্ল্যাঙ্ক সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে বসেন এবং দুটি সূত্র মিলিয়ে সেদিনই উদ্ভাবন করেন এক আনকোরা ‘নতুন সূত্র’।
যা দিয়ে একইসাথে দুটি তরঙ্গ বিকিরণেরই ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।
সূত্রটি প্ল্যাঙ্ক তখনই পাঠিয়ে দেন রুবেন্সের কাছে। রুবেন্সও সেদিন সমীকরণটির গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলেন।
19 অক্টোবর, 1900
জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটি একটি সভার আয়োজন করে। সভার মূল বিষয়বস্তু কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের পরীক্ষার ফলাফল।
বরাবরের মত সেদিনও বিজ্ঞানী ভিন ও রেলে-জিনস তাদের সূত্রের সাথে পরীক্ষার ফলাফল সম্পূর্ণ মেলাতে পারলেন না।
তখন প্ল্যাঙ্ক রুবেন্সকে বলেন তাঁর সূত্রটা যেন বিজ্ঞানীরা একটু যাচাই করে দেখেন। এই বলে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন।
পরদিন সকালে রুবেন্স প্লাঙ্ককে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন তাঁর সূত্রটি বিজ্ঞানীরা ‘নিঁখুত’ বলে রায় দিয়েছেন (তাঁরা সঠিক বলেন নি কারণ ভুল না থাকলেও সম্পূর্ণ নতুন একটি সূত্র কেউ মানতে পারছিলো না)।
প্লাঙ্ক নিজেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি কারণ, তাঁর সূত্র অনেকটাই অনুমাননির্ভর। বিজ্ঞানে অনুমাননির্ভর সূত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। নিশ্চয়ই এ সূত্রের কোনো শিকড় আছে পদার্থবিজ্ঞানে।
এখানে আসলে বলা যায় যে, প্লাঙ্ক নিজেই দ্বিধায় ছিলেন যে তিনি কি সত্যিই বিজ্ঞানে সম্পূর্ণ নতুন একটি দরজা খুলে দিয়েছেন কিনা!
তাই তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন পুরনো কোনো সূত্র খুঁজে বের করতে যা তাঁর নতুন সূত্রকে কিছুটা ভিত্তি দেবে। কিন্তু হাজার খুঁজেও তৎকালীন কোনো সূত্রের সাথেই তিনি তাঁর সূত্রের কোনো মিল খুঁজে পেলেন না।
অথচ প্লাঙ্ক নিজে তাঁর সূত্র বারবার বিশ্লেষণ করে কোন ত্রুটি খুঁজে পান নি। ভুল খুঁজে পান নি সেদিনের সভায় উপস্থিত থাকা বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাও।
তখন প্লাঙ্ক নতুন পথে হাঁটলেন। তিনি তাঁর সূত্র দিয়ে প্রতিপাদন করার চেষ্টা করলেন অন্যদের সূত্র। এবং অবাক হয়ে দেখলেন, ভিন, রেলে, জিনস প্রত্যেকের সূত্র এমনকী বোলজম্যানের পুরনো সূত্র যা পদার্থবিদ্যার কোনো তত্বই মানছিলো না সেই সূত্রও প্লাঙ্কের এই নতুন সূত্র দ্বারা প্রতিপাদন করা যায়। অথচ তাদের প্রত্যেকের সূত্র ছিল সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী!
প্লাঙ্ক তখন নিশ্চিত হলেন বিজ্ঞান ইতিহাসের নতুন দ্বার তিনি খুলে দিয়েছেন। প্রকৃতির সম্পূর্ণ মৌলিক একটি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
আর এভাবেই জন্ম হলো বর্তমান বিজ্ঞানের সবচেয়ে রহস্যময় তত্ব “কোয়ান্টাম তত্ত্ব”
আইনস্টাইন এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব:
কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে আইনস্টাইনের একটা শত্রুতা শুরু থেকেই লেগে ছিল। আইনস্টাইন ঘোর বাস্তববাদী বিজ্ঞানী ছিলেন। মিসির আলির মত তিনিও কোনো অনিশ্চয়তায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু মিসির আলি যেমন তাঁর যুক্তিতর্ক দিয়ে সব মিস্টিরি সলভ করতে পারেন নি তেমনি আইনস্টাইন ও তাঁর জীবনে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি।
আর প্রতিবেদনের শুরুর কথাটাও তিনি বলেছিলেন এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়েই।
যাই হোক, পুরোপুরি মানতে না পারলেও আইনস্টাইনকেও এই তত্ত্ব ব্যবহার করতে হয়েছিলো একবার।
প্লাঙ্ক যখন কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সমস্যার সমাধান করছেন তখনই আরেকটা সমস্যা এসে হাজির হয় পদার্থবিজ্ঞানের জগতে। সেটা হলো আলোক তড়িৎক্রিয়া।
ধাতব পাতের উপর আলো ফেললে সেই পাত থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। কেন? এর ব্যাখ্যা কি?
নিউটনের গতিতত্ত্বের পক্ষে এর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হলো না। ম্যাক্সওয়েলও তাঁর বিদ্যুতচুম্বকীয় তত্ত্বের মাধ্যমে এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না।
এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, তখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আলোকে শুধু তরঙ্গই ভাবতেন। কণাতত্ত্ব বহু আগেই বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা তখন উঠে পড়ে লাগলেন এর ব্যাখ্যা খুঁজতে। তখনও পর্যন্ত প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিজ্ঞানমহলে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারে নি।
এদিকে সমস্ত বিজ্ঞানী যখন এক উপায়ে আলোর তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যার চেষ্টা চালাচ্ছে তখন সুইজারল্যান্ড পেটেন্ট অফিসের কর্মী আলবার্ট আইনস্টাইনের মাথায় ঘুরছে অন্যকিছু।
তিনি তখন ভাবছেন থিওরি অফ রিলেটিভিটি নিয়ে। একইসাথে তাঁর মাথায় ঘুরছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। তিনিও তখন শুরু করেন আলোর তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা খোঁজা। এবং এ জন্য প্রথম যে ভাবনাটি আইনস্টাইনের মাথায় এসেছিল তা ছিল যুগান্তকারী!
আইনস্টাইন ফট করে বলে বসলেন আলো শুধু শক্তি বা তরঙ্গ নয়, কণাও!
বিজ্ঞানীদের মাথায় পড়লো বাজ। বিজ্ঞানমহলে আবারো ফিরে এলো আলোর কণাতত্ত্ব।
তবে নিউটনের কণাতত্ত্বের সাথে আইনস্টাইনের তত্ত্বের কোনো মিল নেই। আলোকে শক্তির প্যাকেট হিসেবে আখ্যায়িত করলেন আইনস্টাইন। তবে তিনি আলোর তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করার ছন্য চিরায়ত কণাবিদ্যা বা বিদ্যুৎচৌম্বকীয় তত্ত্বের দিকে হাত বাড়ালেন না। বরং বিকিরণের জন্য ম্যাক্স প্লাঙ্ক যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়েছিলেন তা দিয়েই ব্যাখ্যা করলেন আলোর তড়িৎক্রিয়া।
প্লাঙ্ক আলোর ক্ষুদ্র শক্তিগুচ্ছকে বলেছিলেন প্যাকেট বা কোয়ান্টাম। আইনস্টাইন আলোর সর্বনিম্ন শক্তির সেই প্যাকেটকেই বললেন আলোর কণা। আরও পরে সেই কণার নাম হয় ফোটন।
ফোটন ভরহীন কণা। কিন্তু গতিশীল ফোটনের ভরবেগ আছে বলে উল্লেখ করলেন আইনস্টাইন। ভরবেগ ও গতিসম্পন্ন কণাকে তিনি তুলনা করলেন কামানের গোলার সাথে। কামানের গোলা যখন কোনো বস্তুকে আঘাত করে তখন তা ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক একইভাবে আলোর ফোটনকণা কামানের গোলার মত প্রচন্ডবেগে আঘাত হানে ধাতুর পরমাণুতে। তখন পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় ইলেকট্রন কণা।
এবার একসঙ্গে দুই সমস্যার সমাধান হল। আলোক তড়িৎক্রিয়ার সমস্যাটা মিটলো একইসাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বও প্রতিষ্ঠিত হলো শক্তপোক্তভাবে।
আলোক তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যার পরই মূলত তরুণ বিজ্ঞানীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর। এর 15 বছর পর নোবেল পান ম্যাক্স প্লাঙ্ক এবং তার পরের বছরই আইনস্টাইন নোবেল পুরষ্কার পান। তবে তিনি কিন্তু এই পুরষ্কার তাঁর বিখ্যাত থিওরি অফ রিলেটিভিটির জন্য পাননি, পেয়েছিলেন আলোক তড়িৎক্রিয়া ব্যখ্যার জন্য।
যেভাবে সূত্রপাত কোয়ান্টাম বলবিদ্যার:
এবারের আলোচনাটা খুব জটিল এবং বড়। পাঠকের সুবিধার্থে অল্প কথায় সহজে বোঝানোর চেষ্টা করছি,
সময় 1911 সাল,
এই সময়ে নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড তৈরী করেন পরমাণু মডেল। কিন্তু তার এই মডেলে কিছু ত্রুটি ছিল।
এই মডেলের নকশা ছিল সৌরজগতের অনুরূপে। সূর্যকে কেন্দ্র করে যেমন সব গ্রহ একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে তেমনি রাদারফোর্ডের তত্ত্ব অনুযায়ী ইলেকট্রন নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
সুন্দর এই তত্ত্বের সুন্দর একটা নাম দেওয়া হয়, ‘সোলার সিস্টেম অ্যাটম মডেল’।
কিন্তু বাধ সাধলেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তিনি বললেন, চার্জিত কণা নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরলে বিদ্যুতচৌম্বকীয় তরঙ্গ বা তার চার্জ বিকিরণ করে। এই চার্জই নিউক্লিয়াসের কাছ থেকে ইলেকট্রনকে নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখতো। কাজেই এভাবে যদি ইলেকট্রনটি চার্জ ত্যাগ করতে থাকে তাহলে আস্তে আস্তে ইলেকট্রনটি নিউক্লিয়াসের কাছে আসতে থাকবে এবং একসময় নিউক্লিয়াসের গায়ে আছড়ে পড়বে!
ইলেকট্রন যদি নিউক্লিয়াসের উপর গিয়ে পড়ে তাহলে পরমাণুর ভারসাম্য ঠিক থাকবে না। রাদারফোর্ডের মডেল তাহলে নিজেই নিজেকে বাতিল করে দিচ্ছে!
এতবড় একটা অসংগতি নিয়ে তো বিজ্ঞান চলতে পারে না। ফলে আরো একবার বড় একটা সমস্যার মুখোমুখি হল পদার্থবিজ্ঞান। যেমনটা হয়েছিল কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণে, যেমনটা হয়েছিল আলোক তড়িৎক্রিয়ায়। দুই ক্ষেত্রে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিল কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এবার কে কাজে লাগাবে এই তত্ত্বকে। কোনো বিজ্ঞানী একবারো ভাবলেন না এই তত্ত্বের কথা। শেষে ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হলেন ডেনিশ বিজ্ঞানী নিলস বোর।
বোর দেখলেন বিদ্যুতচৌম্বকীয় তত্ত্ব দিয়ে তো রাদারফোর্ডের মডেল ব্যাখ্যা করা যায় না। তাহলে প্লাঙ্ক-আইনস্টাইনের প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টাম তত্ত্বকে কাজে লাগালে কেমন হয়?
যদিও বোরের নিজেরও শুরুতে খুব একটা আস্থা ছিল না এই কাল্পনিক হাইপোথিসিসের উপর। যা হোক বোর পরীক্ষা শুরু করলেন।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে বোর যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তা বইয়ের ভাষায় বলে গেলে সাধারণ পাঠকদের মাথার উপর দিয়ে যাবে। আসুন আমরা একটা উদাহরণে যাই,
রাদারফোর্ডের তত্ত্ব অনুযায়ী পরমাণুর একটা কক্ষপথ আছে যেখানে সে ঘুরতে থাকে এবং চার্জ ত্যাগ করতে করতে নিউক্লিয়াসের নিকটবর্তী হতে থাকে।
মনে করুন আপনি হচ্ছেন ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াস হলো খারাপ পথ। আর ইলেকট্রনের চার্জ অর্থাৎ আপনার চার্জ হলো টাকা। মনে রাখবেন আপনি এখানে ইলেকট্রন। তো আপনি খারাপ পথকে ঘিরে ঘুরছেন এবং আপনার পকেটভর্তি টাকা। আপনার কাছে আছে 100 টাকা এবং আপনি খারাপ পথের 100 মাইল দূরে আছেন। আপনার এক টাকা এক টাকা করে খরচ হচ্ছে আর আপনি এক মাইল এক মাইল করে খারাপ পথের দিকে আগাচ্ছেন। যখন আপনার টাকা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে তখনই আপনি খারাপ পথে প্রবেশ করবেন।
এটা হলো রাদারফোর্ডের তত্ত্ব। কিন্তু এখানে নিলস বোর এসে বললেন রাদারফোর্ডের তত্ত্ব ভুল।
বোর তৈরী করলেন নতুন তত্ত্ব।তিনি বললেন, আপনি খারাপ পথের দিকে চাইলেই যেতে পারবেন না। ধরুন আপনি আছেন পাঁচ তলায়। নিউক্লিয়াস আছে নিচতলায়। প্রত্যেক এক তলা নামতে আপনার খরচ হবে দশ টাকা। আপনার কাছে আছে পঞ্চাশ টাকা। আপনি দশটাকা খরচ করে এক তলা নামলেন। এখানে আপনাকে থামানো হলো। আপনি এখানেই ঘোরাঘুরি করতে থাকবেন। আপনার কোনো টাকা খরচ হবে না। যখনই আপনি আরো দশ টাকা খরচ করবেন আপনাকে আরেক তলা নামিয়ে দেওয়া হবে। এবং বোর এটাও বললেন যে আপনি শুধু নামতেই থাকবেন তা না। আপনি আপনার টাকা বাড়াতে পারবেন। ধরুন আপনার কাছে আছে ত্রিশ টাকা আপনি আছেন তিন তলায়। হঠাৎ যদি আপনার দশ টাকা বেড়ে যায় আপনার টাকা হয়ে যাবে চল্লিশ। তখন আপনি একলাফে চলে যাবেন চার তলায়।
এখন বলুন এখানে কোনটা কি? এখানে আপনি হলেন ইলেকট্রন। নিচতলা হলো নিউক্লিয়াস এবং আপনার কাছে যে টাকা আছে সেটা হলো ইলেকট্রনের চার্জ এবং যে তলাগুলোর কথা হয়েছে তা হলো ইলেকট্রনের কক্ষপথ। খুব ঠান্ডা মাথায় আরেকবার পড়ুন, বুঝতে পারবেন।
যাই হোক, তাহলে বোরের তত্ত্বের মোদ্দাকথা হলো, ইলেকট্রন শক্তি ত্যাগ করতে পারে আবার গ্রহণও করতে পারে। এবং সে তার শক্তি অনুযায়ী পরমাণুর যেকোনো কক্ষপথে থাকতে পারে।
এই নতুন তত্ত্ব আগের সব তত্ত্বকে বাতিল করে দিলো। এবং এক্ষেত্রে মুখ্য চরিত্রে থাকা কোয়ান্টাম তত্ত্বে প্লাঙ্ক বলেছিলেন, কৃষ্ণবস্তু একটানা শক্তি বিকিরণ করতে পারে না। শক্তি আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। ছোট ছোট দল বেঁধে। যাকে বলা হয় প্যাকেট বা ফোটন। বোর অনেকটা একই কথা বললেন তার তত্ত্বে। পরমাণুর কক্ষপথও আলাদা আলাদা। ইলেকট্রন যেকোনো সময় যেকোনো কক্ষপথে থাকতে পারে।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, “ইলেকট্রন একটি পরমাণুর যে একাধিক কক্ষপথ রয়েছে তার সবগুলোতে একইসাথে একইসময়ে থাকতে পারে!” (পয়েন্ট টু বি নোটেড)
এখানেই শুরু হয় কোয়ান্টাম তত্ত্বের আসল খেলা। এই অবস্থানের অনিশ্চয়তাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। এটা নিয়ে আলোচনা করা হবে পরবর্তী পর্বে।
(লেখকের কথা: কোয়ান্টাম তত্ত্ব এমন একটি তত্ত্ব যা কোনো বিজ্ঞান মানে না। এই একটা তত্ত্ব বিজ্ঞানের সকল তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে পারে। কিন্তু এই তত্ত্বকে বিজ্ঞান কখনো না পেরেছে অস্বীকার করতে, কখনো না পেরেছে এর সমাধান করতে। শুধু এটাই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে এই তত্ত্বই সকল তত্ত্বের মূল। এর মাঝেই রয়েছে সকল রহস্য। কাজেই বুঝা যায় কতটা ভয়ংকর বিদঘুটে আর পেঁচানো এই তত্ত্ব। সাধারণ মানুষ তো দূর অনেক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষও এই তত্ত্ব সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। আমিও এখানে বেশ কিছু তত্ত্ব জাষ্ট উল্লেখ করেছি সেগুলো বিশ্লেষণ করিনি কিছুক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে কিছুক্ষেত্রে সময় বাঁচাতে। আমি যে এই কয়টা লাইন লিখেছি এগুলোই মাথায় ঢুকাতে আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে টানা দুই বছর। দুই বছর ধরে টানা আমি এই তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছি। চেষ্টা করেছি যতটা সহজভাবে সম্ভব মূল কথাটা পাঠকের মাথায় ঢুকানোর। কারো যদি এই আলোচনাটার মধ্যে কোনো জায়গায় বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। মূলত এই প্রতিবেদনটা জাষ্ট শুরু। কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকটা পর্ব পাবলিশ হবে ছারপোকার পেইজে। তাই অনুরোধ করবো নিয়মিত পেইজে চোখ রাখার জন্য। ধন্যবাদ।)