‘নিরাপদ সড়ক চাই’ – এই স্লোগানটি বর্তমানে সবার মুখে মুখে। ইন্টারনেট, ফেসবুক সহ ভার্চুয়ালে এখন তোলপাড় চলছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে। শুধু ভার্চুয়াল না, আন্দোলন নেমেছে রাস্তাতেও। মূলত আন্দোলনের সূত্রপাত সড়কেই। নিরাপদ সড়কের দাবি শিক্ষার্থীদের হাত ধরে শুরু হলেও এখন আন্দোলনে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে অভিভাবক, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় তারকারাও।
নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে আন্দোলন বর্তমানে আলোচনায় আসলেও সড়ক দুর্ঘটনা কিন্ত কোনো আজকালকের ঘটনা না। এটি অনেক আগে থেকেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া !
বিশ্বাস হচ্ছে না? আসুন বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কিছু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক –
সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর ২০১৬ সালের এক জরীপে জানা যায় –
- প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ১৬৬ জন নিহত হন
- গড়ে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষ মারা পড়েন ‘সড়ক দুর্ঘটনায়’
- এর আগে ২০০৩ সালে একটা জরিপ করা হয়েছিল৷ তাতে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু (১৮ বছরের নীচে) মারা যায় ৯ জন৷ কিন্তু এবারের জরিপে সেই সংখ্যা ১৪ জন
- প্রতিদিন ১৪ টি শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেও প্রাপ্ত বয়স্ক নিহত হন ৫০ জন৷ নিহতের হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাপ্ত বয়স্ক নিহতের সংখ্যা সর্বোচ্চ
- সড়ক দুর্ঘটনাসহ আরও নানা অপঘাতে প্রতিদিন বাংলাদেশে ৩০০ মানুষ নিহত হন৷ পঙ্গু হন ৬৬০ জন৷
এই সংখ্যা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ।
মানুষ খুনে চ্যাম্পিয়ন সড়ক দুর্ঘটনা
আমাদের সড়কে গাড়ি চালকরা মাঝে মাঝেই রেস প্রতিযোগিতায় নামেন। এবং এই রেসে তারা সামনে পড়া মানুষ নামক কোনো প্রতিবন্ধকতাকে পিষে ফেলতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেন না। তাদের এই ত্যাগ সার্থক। কারণ প্রতিবছর তারা যে পরিমাণ মানুষ মারেন অন্য কোন কারণেই এত বেশি মানুষ মারা পড়ে না।
২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে করা জরিপে দেখা যায়,
- প্রতি বছর এদেশে আত্মহত্যা করেন ২২ হাজার ৮৬৮ জন
- পানিতে ডুবে মারা যায় ১৯ হাজার ২৪৭ জন
- উচু স্থান থেকে পড়ে মারা যায় ১৫ হজার ৪৫ জন
- বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৯ হাজার ২১০ জন
- সরাসরি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৬ হাজার ৪৭৫ জন
অর্থাৎ জনসংখ্যা হ্রাস করতে সড়ক দুর্ঘটনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। We should be thankful !
দায়ী কে?
চালক : চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অভিজ্ঞতার অভাব, অতিরিক্ত দুঃসাহস এবং যৌবনের গরম রক্তের উত্তেজনার কারণেই ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়াও রয়েছে অন্য গাড়ির সাথে পাল্লা দেওয়া, শিক্ষার্থী দেখলে গতি বাড়িয়ে দেওয়া, ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী তোলা ইত্যাদি। বাস ছাড়াও অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা মেইন রোডে ব্যাক্তিগত গাড়ি বা মটরসাইকেল চালাতে গিয়ে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনার মুখে পড়ে।
সিস্টেম : সিস্টেমের কথা বলতে গেলে আসলে অনেক কিছুই চলে আসে। আমাদের দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে চরম অনাবস্থ্যা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং দুর্নীতি। যে কারণে খুব সহজেই মিলছে গাড়ি চালকের সনদ।
বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, দেশে ভারি যানবাহনের প্রায় আড়াই লাখ চালক রয়েছেন। তাদের ১ লাখ ৯০ হাজার লাইসেন্স পেয়েছেন পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে। তারা লাইসেন্স পান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেয়া তালিকা ধরে।
সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, তিন ধরনের লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এর কোনটিরই সঠিক মান যাচাই করা হয় না।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে প্রায় ২৭ লাখ। এর মধ্যে অন্তত ৪ লাখের ফিটনেস সনদ নেই। আর যেসব যানের সনদ আছে, সেগুলোর বেশির ভাগ দেয়া হয়েছে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। কারণ, মোটরযান আইনে যানবাহনের ৫০টির বেশি কারিগরি পরীক্ষা নিশ্চিত করেই চলাচলের সনদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব যাচাই করা হয় যন্ত্রের সাহায্যে। আর আমাদের দেশে যাচাই হয় পকেট কতটুকু ফুলেছে তার উপর ভিত্তি করে!
অসচেতনতা : ইংরেজীতে যখন স্ট্রিট এক্সিডেন্ট নিয়ে প্যারাগ্রাফ লিখতাম তখন আগে বলতাম people should be aware of this incident পরে বলতাম government should take necessary steps.
অর্থাৎ, দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের তুলনায় জনগনের সচেতনতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার জনগণের জন্য যতটুকু ব্যবস্থা করেছে তার কতটুকু জনগণ ব্যাবহার করে? ব্যস্ত নগরীর ব্যাস্ত সড়কে কয়জন মানুষ ওভারব্রিজ বা ফুটপাত ব্যবহার করে?
গড়ে আমাদের দেশে প্রতি দশ জনে একজন ওভারব্রিজ ব্যাবহার করে রাস্তা পার হয়। বাকিরা সুপারহিরোদের মত যান্ত্রিক দানবদের মাঝ দিয়ে বিভিন্ন শারীরিক কসরত দেখিয়ে রাস্তা পার হয়। শিক্ষার্থীরা তো এক্ষেত্রে আরো এক কাঠি এগিয়ে। তাদের রাস্তা পার হওয়া বা চলন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে পড়া দেখলে নিঃসেন্দেহে স্বীকার করে নেওয়া যায়, অলিম্পিকে এ জাতির ভবিষ্যত্ উজ্জ্বল!
সরকার : সরকারের সাথে সিস্টেমও জড়িত। এদেশের সিস্টেম এতটাই খারাপ যে সরকার প্রতিবছর বাজেটের যে অংশটা সড়ক উন্নয়নে বরাদ্দ রাখে তার সিকিভাগও সড়কের উন্নয়নে ব্যয় হয় না। বরং সিংহভাগই ব্যয় হয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেট মেরামতে।
বললে তো বলবেন প্রমাণ কই?
প্রমাণ নাই। আন্দাজে বলছি। কিন্তু এত অর্থ যে বিনিয়োগ হচ্ছে এর ফল কোথায়? ষ্কুল কলেজের সামনে ওভারব্রিজ কই? স্পিডব্রেকার কই? ট্রাফিক পুলিশ কই? ফুটপাত কই?
তিন ফুটের ফুটপাত সব ভ্যানের দখলে। রাস্তার অর্ধেক দখল শাকসবজির ভ্যানে। হাঁটতে হয় রাস্তার মাঝখান দিয়ে। এত অনিয়ম এত অব্যাবস্থাপনা কেন? এর দায় কার? উঁহু প্রশাসন ঘুমাচ্ছে, বিরক্ত করা যাবে না।
ইদানীং দেখা যায় বছরের মাঝামাঝিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হয়, বছর শেষ হওয়ার আগেই সব খতম। ফলাফল দুইদিন পরেই ভাঙা রাস্তায় রিকশা উল্টে পড়ে, বাস খাদে পড়ে, বৃষ্টিবিলাসী কবি খোলা ম্যানহোলে পড়ে দুর্গন্ধময় কবিতা রচনা করে আর পত্রিকায় বড় হেডলাইনে ছাপা হয় ‘অমুক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় এতজন নিহত, এতজন আহত!’
যেহেতু বলাই থাকে দুর্ঘটনা তাই জনগণের দুই মিনিট নিরবতা পালন করে শোক প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
সরকারকে দায়ী করতে হলে আরো যে বিষয়টি সামনে আসে তা হল পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ কোথায়? আইন প্রণয়ন করা আছে কিন্তু আইন কার্যকর করার লোক কোথায়? আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধী পালিয়ে যাচ্ছে। পকেট ফুলিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে আইন ভঙ্গকারীদের। এসব দেখার লোক কোথায়?
পাল্টা যুক্তি আসবে, ‘এত লোক পাবো কোথায়? দেশে তো এখন বেকারত্বের হার শূন্য!’
সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অবস্থান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গত বছরের গবেষণা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
কিন্তু এই দেশগুলোর প্রতিটিতে যানবাহনের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। আর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে পুরো বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম।
২০১৪ সালের তথ্য ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গবেষণা করেছে। সে হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ১ হাজার ১৩৩টি যানবাহন রয়েছে। চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার যানবাহন। ভারতে প্রায় ১৩ হাজার। আর পাকিস্তানে পাঁচ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দুজনে একটি করে যানবাহন রয়েছে। এই দেশগুলোতে জনসংখ্যাও প্রচুর। যানবাহনের হিসাব দেয়া হয়েছে মোটরসাইকেলসহ।
কাজেই ঠান্ডা মাথায় হিসাব করলে দেখা যাবে আমরাই সবার চেয়ে এগিয়ে আছি। সুতরাং দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। যে গতিতে আমরা আগাচ্ছি তাতে আশা করাই যায় যে, খুব শীঘ্রই বৈশ্বিক এ প্রতিযোগিতায় আমরা প্রথম স্থান অধিকার করব!
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয়
উপরের সকল পরিসংখ্যান সাধারণ জ্ঞান বৃদ্ধিতে কাজে লাগলেও সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারবে না। এই তথাকথিত দুর্ঘটনা কমাতে অজুহাত না খুঁজে গ্রহণ করতে হবে সঠিক ব্যবস্থাপনা।
বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা নয় দফা দাবি প্রকাশ করেছে। যা মেনে নেওয়ার জন্য সরকার কর্তৃক আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় এই দাবিগুলো কার্যকর করা হলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে।
দাবিগুলো হচ্ছে –
১. বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে।
২. নৌপরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার দিতে হবে।
৫. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
৬. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে।
৭. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করতে হবে।
৯. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।
এই দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের চলমান কার্যক্রম বেশ প্রশংসনীয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা জনপথে নেমে সারাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চালাচ্ছে। লাইসেন্সবিহীন যানবাহন রাস্তা থেকে সড়িয়ে দিচ্ছে। ছাড় দিচ্ছে না সরকারী, মন্ত্রী কিংবা পুলিশ-সেনাবাহিনীর গাড়িও। যার ফলে রাওআরাতি জনপথে কমে গেছে পাবলিক গাড়ির সংখ্যা। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে কতটা অনিয়মের মধ্যে বাস করছিলাম আমরা।
পাবলিক যানবাহন কমে যাওয়ায় যদিও সাধারণ মানুষ সাময়িক দুর্ভোগে পড়েছে কিন্তু উন্নয়নের কাজে দুর্ভোগ পোহাতে এ জাতি অভ্যস্ত। তাই এখন সকলেই এই আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
দেশের মানুষ দেশ মেরামতে নেমেছে। এখন চাওয়া একটাই মাঝপথে এই উন্নয়ন থেমে না যাক। ডিজিটাল বাংলা নাহয় পরে হবে, আগে সোনার বাংলা ঠিকমত গড়ে উঠুক।