জাপান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৪৭২, বাংলাদেশের ইতিহাসের একমাত্র বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা, যার মূল হোতা জাপানিজ রেড আর্মি। এটি একটি কমিউনিষ্ট মিলিটেন্ট গ্রুপ, যারা দীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন এয়ারলাইনসে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে আসছিলো।
১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, Japan Airlines Flight 472 নামের একটি জাপানি বিমান ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে জাপানের টোকিওর হেনাডা বিমানবন্দরের দিকে যাত্রা করে। পথে যাত্রাবিরতি ছিল ভারতের মুম্বাইয়ে। মুম্বাই থেকে ওড়ার পর ইউনাইটেড রেড আর্মি নামে জাপানের ওই সন্ত্রাস দল ওই বিমানটি হাইজ্যাক করে। ৫ সদস্যের হাইজ্যাকার দলটি ১৫৬ জন যাত্রী ও ক্রুদের জিম্মি করে ফ্লাইট ৪৭২ বিমানটিকে জোর করে অবতরণ করায় ঢাকার পুরাতন তেজগাঁও এর বিমানবন্দরে। মুক্তিপন হিসাবে তারা জাপান সরকার কাছে ৬ মিলিয়ন ডলার এবং তাদের আটক ৯ সদস্যদের মুক্তি দাবী করে।
টানা ৪ দিন তারা হাইজ্যাক করা বিমান নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে। যুদ্ধপরবর্তী শান্ত দেশটি আবারো গরম হয়ে ওঠে নতুন ইস্যুতে। এরকম বড়ধরণের হাইজ্যাকিং ও জিম্মির ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। তাই বাংলাদেশের প্রশাসন ও বিমান বাহিনীর জন্য এটি ছিলো বেশ বড় ধরণের চ্যালেঞ্জিং একটি ঘটনা।
অবশেষে ১ অক্টোবর জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকিও ফুকুদা ঘোষণা করেন যে, সরকার ছিনতাইকারীদের দাবী মেনে নিতে রাজি আছে। এই ঘোষণা দেয়ার পর ছিনতাইকারী সংগঠনের ৬ কর্মীকে মুক্তি দেওয়া হয়। এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও সরকারের মধ্যস্ততায় জাপান সরকারের বিমানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ২ অক্টোবর তাদের দাবী মেনে নেয়া সাপেক্ষে সেই হাইজ্যাক নাটকের অবসান হয়। ফ্লাইট ৪৭২ বিমানের সকল যাত্রীরা মুক্তি পায়। যাত্রীদের বাংলাদেশে নামিয়ে দিয়ে হাইজ্যাকাররা বিমানটি আলজেরিয়ার পথে উড়িয়ে নিয়ে যায়।
১৯৭৭ সালে এখনকার মত মিডিয়া না থাকায় সেই সময়কার তেমন কোনো রেকর্ডই এখন আর সংরক্ষিত নেই। একমাত্র বিটিভি এই ঘটনাটি নিয়ে আংশিক সম্প্রচার করে, যার কোনো আর্কাইভ এখন আর সংরক্ষিত নেই।
জাপানিজ রেড আর্মি’র আরো কিছু আক্রমণ
- মার্চ ১৯৭০, জাপান এয়ারলাইন্সের ৩৫১ নং ফ্লাইট, বোয়িং ৭৪৭ বিমান টোকিও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১২৯ যাত্রী নিয়ে আকাশে ওড়ে। বিমানটিকে রেড আর্মি ফ্যাকশন বাধ্য করে ফুকুওকা বিমানবন্দরে অবতরণ করতে। কোরিয়ার সিউলে সমস্ত যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়া হয়। বিমানটিকে উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে বিমানসহ ক্রুদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার জন্য ইয়োশিমি তানাকা দণ্ডিত হয় ১২ বছরের কারাবাসে। পুলিশের ভাষ্যমতে তার ৮ জন সঙ্গী উত্তর কোরিয়াতেই মারা যায়।
- মে ১৯৭২, লড এয়ারপোর্ট ম্যাসাকার ! এ আক্রমণে তিনজন জাপানিজ রেড আর্মি সদস্য অংশ নেন। একজন গ্রেনেড ফাটিয়ে আত্মহত্যা করেন। যদিও অনেকে সেটাকে দুর্ঘটনা মনে করে। আরেকজন মারা যান ক্রসফায়ারে। আর তৃতীয়জন কোজো ওকামোটো কেবল বেঁচে যান। অনেকের ভাষ্যমতে এই ব্যক্তি পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিনিদের সুইসাইড অ্যাটাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই আক্রমণের পেছনে পিএফএলপি জড়িত রয়েছে বলে দাবী করা হয়েছিলো, কিন্তু তা আজও প্রমাণিত হয়নি।
- জুলাই ১৯৭৩, রেড আর্মি সদস্যরা নেদারল্যান্ডসের ওপর থেকে জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে। লিবিয়াতে সমস্ত যাত্রী নামিয়ে ছিনতাইকারী সদস্যরা বিমানটাকে ধ্বংস করে দেয়।
- জানুয়ারি ১৯৭৪, রেড আর্মি সিঙ্গাপুরে থেকে ৫ জনকে জিম্মি করে। একই সময়ে পিএফএলপি কুয়েতের জাপান দূতাবাসে দখল করে। আটককৃতদের মুক্তির জন্য দাবি করা হয় মুক্তিপণ, সঙ্গে দক্ষিণ ইয়েমেনে যাওয়ার জন্য বিমান।
- সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, নেদারল্যান্ডসের হেগে ফরাসি দূতাবাস দখলে নেয় রেড আর্মি। রাষ্ট্রদূত এবং আরো ১০ জনকে বন্দি করা হয়। দাবি ছিল রেড আর্মির দণ্ডিত আসামি ইয়াৎসুকা ফুরাইয়াকে মুক্তি দিতে হবে। সঙ্গে ৩ লাখ মার্কিন ডলার এবং একটি বিমান।
- আগস্ট ১৯৭৫, রেড আর্মি কুয়ালালামপুরে ৫০ জনকে জিম্মি করে। যার মধ্যে একজন ইউএস কনসাল এবং একজন সুইডিশ চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স ছিলেন। ৫ জন সঙ্গীকে মুক্ত করে তারা লিবিয়াতে উড়ে যায়।
- মে ১৯৮৬, কানাডা, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের জাকার্তা দূতাবাসে মর্টার হামলা করে।
- জুন ১৯৮৭, রোম ও ইতালিতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে মর্টার হামলা।
- এপ্রিল ১৯৮৮, ইতালির নেপলসে ইউএস মিলিটারি রিক্রিয়েশনাল ক্লাবে বোমা হামলায় চালায়। ৫ জন সেনা নিহত হয়।
আরো পড়ুনঃ