সনাতন ধর্ম নাম শুনলে অনেক জ্ঞানী লোকও প্রথমে মনে করেন এটি একটি ভিন্ন ধর্ম যা অনেকে পালন করে। এখনো অনেকেই জানেন না সনাতন ধর্ম আসলে হিন্দু ধর্মেরই সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বলা হয় মুসলমান। তেমনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বলা হয় হিন্দু।
সনাতন বা হিন্দু ধর্মের প্রবর্তন সৃষ্টির শুরু থেকে। সনাতন ধর্মকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম বলে মনে করা হয়ে থাকে। তবে আমাদের সমাজে সনাতন ধর্ম সম্পর্কে অনেকেই কিছু তথ্য জানেন, যা সম্পূর্ণ ভুল। অনেকেই ভেবে থাকেন সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো গীতা। অনেকে ভাবেন রামায়ণ, অনেকে মহাভারত। এমনকি অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও অজ্ঞতার কারণে এটাই মনে করে থাকে। কিন্তু হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো “বেদ” ! ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে কোরআন শরীফ এর বাণী যেমন শিরোধার্য, তেমনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও বেদ এর বাণী শিরোধার্য।
সনাতন ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের শেষ নেই। সনাতন ধর্মের যেই বিষয়টি প্রতিটি মানুষের মনে অসংখ্য প্রশ্ন সৃষ্টি করে, তা হলো বর্ণপ্রথা। বর্ণপ্রথা নিয়ে তর্ক বিতর্কের শেষ নেই। তবে বর্ণপ্রথা শব্দটিকে বর্তমান সময়ে যতটা ঘৃনার চোখে দেখা হয়, আগে বা প্রাচীন যুগে সেটি ভাবার কোনো কারণ ছিলো না !
হিন্দুধর্মে বর্ণপ্রথা
হিন্দু বা সনাতন ধর্মে বর্ণপ্রথা বলতে আসলে কিছুই নেই। সৃষ্টির শুরুতেই সনাতন ধর্মের কল্যাণ ও মঙ্গলের কথা চিন্তা করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভাগ করা হয়েছিলো ৪ ভাগে…
- ব্রাহ্মণ
- ক্ষত্রিয়
- বৈশ্য
- শুদ্র
বর্ণপ্রথা বা সনাতন ধর্মের এই বিভাগকরণ তাদের ভালোর জন্য করা হলেও কালক্রমে তা খারাপের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এজন্য দায়ী মানুষের নিচু মন মানুষিকতা। হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথার বিবর্তনকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে…
- প্রাচীন
- মধ্যযুগীয়
- আধুনিক
সনাতন ধর্মে ৪টি ভাগ করা হয়েছিলো। তাদের কেউ উঁচু কিংবা কেউ নিচু তা নয়। তারা সকলেই সমান এবং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে রয়েছে। ১টি সমাজে যেমন একে অপরের মধ্যে সাহায্য ছাড়া কেউ চলতে পারেনা, তেমনি সনাতন ধর্মের ৪টি শ্রেণী এমন ভাবে করা হয়েছিলো, যাতে তাদের মধ্যেকার ভাতৃত্ত্বের সম্পর্ক মজবুত হয় এবং তাদের সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকে।
এবার সনাতন ধর্মের বর্ণপ্রথা বিবর্তন নিয়ে আরো খোলাসা হওয়া যাক…
প্রাচীন যুগ : হিন্দুধর্মের ভিতর ৪ টি শ্রেণী করা হয়েছিলো। যাদের ভিতর ব্রাহ্মণ দের কাজ ছিলো পূজা অর্চনা,যজ্ঞ,ধর্ম্প্রচার এবং সমাজ ও সৃষ্টির সকল জীবের কল্যাণের জন্য আরাধনা করা। তারা পূজা অর্চনা ও যজ্ঞের মাধ্যেমে সবার কল্যাণ কামনা করতেন।
ক্ষত্রিয়দের কাজ ছিলো সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সমাজে অন্যায় অত্যাচার হলেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং প্রয়োজন এ অস্ত্র তোলা। কেউ যদি কোন অপরাধ করতো তাহলে তাদের বিচার এর ভার ছিলো তাদের উপরে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের এবং তাদের সমাজের অন্য সকলকে রক্ষা করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিলো তাদের উপরে। বৈশ্যদের কাজ ছিলো ব্যবসা বাণিজ্য করা, তারা অধিকাংশ ছিলো বণিক। তারা ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যেমে যা আয় করতো তা সবটাই নিজের জন্য রাখতো না। তারা নিজের জন্য প্রয়োজনীয় অংশ রেখে বাকি সবটাই দিয়ে দিতো অন্য ৩ শ্রেণীর মানুষদের কাছে এবং তারা এটা করতে বাধ্য থাকতো সব সময়। শুদ্রদের কাজ ছিলো চাষবাস,বাড়িঘর স্থাপনা নির্মাণ করা,মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং অন্যান্য যাবতীয় কাজ করা। এভাবে প্রত্যেকে তাদের কাজ করতো। প্রত্যেকে নির্ভর করতো একে অন্যের উপর। একজন ছাড়া অন্যজন সম্পূর্ণ অচল। এভাবে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো শক্ত ও দৃঢ় বন্ধন।
মধ্যযুগীয় : সনাতন ধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় হিসেবে ধরা হয় মধ্যযুগকে। মধ্যযুগে সনাতন ধর্মের ৪টি শ্রেণীতে বিভেদ হতে থাকলো। ব্রাহ্মণ সমাজ নিজেদেরকে অধিক বিজ্ঞ এবং জ্ঞানী দাবি করলো। অন্য ৩ শ্রেণী তা মানতে বাধ্য হয়, কারণ তারা মনে করত যেহেতু ব্রাহ্মণরা পূজা অর্চনা থেকে শুরু করে ধর্মীয় সকল কাজ করে থাকে স্রষ্টার সাথে তাদের অবশ্যই কোন সংযোগ রয়েছে। ধর্মের প্রতি তাদের অন্ধবিশ্বাস ই তাদের এই পরিণতির মূল কারণ। তাদের এই অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্রাহ্মণরা সমাজের অধিপতি বনে গেল। তাদের সাহায্য করার জন্য ক্ষত্রিয়দের নিয়োগ করা হলো তাদের দেহরক্ষী হিসেবে। সমাজের নিজেদের অধিকার বজায় রাখার পাশাপাশি তারা ক্ষত্রিয়দের অধিকারে ভাগ বসালো। বৈশ্যবা ব্যবসায়ীরা তাদের কথামত সবকিছু করতে শুরু করলো। কোন রাজ্য বছরে যে আয় হতো তার ৫০ ভাগ ভোগদখল দিতো ব্রাহ্মণরা। বাকি ৫০ ভাগের ২৫ ভাগ পেত ক্ষত্রিয়রা। বৈশ্যরা পেত ২০ ভাগ। শুদ্রদের দেখা হতো সবচেয়ে নিচু হিসেবে।তাদের মাত্র ৫ভাগ প্রদান করা শুরু হলো। মোট কথা ক্ষমতার লোভে তারা একে অপরের থেকে ভাতৃত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করে তৈরি করলো বর্ণপ্রথা তথা জাতপাত ভেদাভেদ। শুদ্রদের উপরেই বেশি অত্যাচার করা হত। আর ক্ষত্রিয়রা তাদের নিজেদের কথা ভেবে মুখ বুজে সব করত, যা ব্রাহ্মণরা আদেশ করে। এভাবেই বর্ণপ্রথা এতোটাই সমাজে বিষ নিক্ষেপ করে যে অন্য কোনো শ্রেণী যাদের নিচু বলে গণ্য করা হয় তারা যদি বাড়ির পরে বা উঠান দিয়ে হেটে যেতো সেখানে শুদ্ধিকরণ এর জন্য পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলা হত। এভাবেই প্রাচীন সুষ্ঠ ভাবধারাকে মানুষ নিজের স্বার্থে তৈরি করলো এক বৈরি এবং অত্যাচার এর ভাবধারা যেখানে পর্যায়ক্রমে এক দল শাসক আরেকদল শোষক।
আধুনিক : আধুনিক যুগ বলতে বর্তমান যুগ কে ধরা হয়ে থাকে। এটি এখনো চলমান। এই যুগকে বলা হয়ে থাকে সনাতন ধর্ম পুনঃসংস্কার এর যুগ। এই যুগ এর শুরু থেকেই নিচু জাত হিসেবে পরিগণিত লোকেরা তাদের উপর অন্যায় অত্যাচার এর বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়। প্রথম দিকে তেমন সুবিধা না হলেও আস্তে আস্তে শুদ্র থেকে বৈশ্য এবং এরপরে ক্ষত্রিয়রা তাদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট হয় এবং প্রতিবাদ করে। ব্রাহ্মণ সমাজের অনেক সচেতন মানুষ ও এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কারণ তারা বুঝতে পারে ধর্ম সংস্থাপন ও প্রচার করার নামে তারা একটি অন্যায়ের রাজত্ব সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত কিছু ব্রাহ্মণ ব্যক্তি তাও মানতে না চাইলে তাদের বিরুদ্ধে সবাই রুখে দাঁড়ায়। ফলে তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কেউ তাই প্রাচীন যুগের মতো অপরের উপরে নির্ভর না করে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নেয়। শিক্ষা থেকে শুরু করে সবকিছুতে সব শ্রেণীই সমান ভাবে অগ্রসর হয়, যা এখনো চলমান এবং ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে।
প্রতিটি ধর্মই সত্য ও ন্যায়ের পথে কথা বলে। কোন ধর্মেই বলা নেই একে অপরকে ভিন্ন চোখে দেখবে। প্রতিটি ধর্মের পথ ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য এক।