আমরা সার্কাজমপ্রিয় জাতি বলেই পৃথিবীর অনেক দেশের নাম নিয়ে ট্রল করি, হাসিঠাট্টা করি। তেমনই একটি দেশ হন্ডুরাস ! হাসিঠাট্টার অন্তরালে এইসব দেশগুলোর সফলতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সহ অনেক কিছুই আমাদের অজানা। আগের পর্বে এরকমই একটি দেশ উগান্ডা সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম। এ পর্বে জানবো হন্ডুরাসের মাছবৃষ্টি সহ আরো কিছু অদ্ভুতুড়ে তথ্য ! চলুন অল্পকথায় জেনে নেয়া যাক হন্ডুরাস সম্পর্কে জানা অজানা সবকিছু…
বিশালতার দেশ হন্ডুরাস
হন্ডুরাস শব্দটি স্প্যানিশ যার অর্থ হলো ‘গহীন’। এর স্প্যানিশ উচ্চারণ হচ্ছে ‘ওন্দোরাজ’। হন্ডুরাস মধ্য আমেরিকার একটি দেশ। একসময় এটিকে স্প্যানিশ হন্ডুরাস বলা হত। কারণ ব্রিটিশ হন্ডুরাস নামের আরেকটি দেশ ছিলো। সেটি এখন বেলিজ দেশের একটি অংশ। স্পেনের কাছ থেকে ১৮২১ সালে এই ছোট্ট দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। রাজধানী ও সর্ববৃহৎ শহরের নাম টেগুসিগালপা। ১ লাখ ১২ হাজার ৪৯২ বর্গকিলোমিটারের দেশটিতে জনসংখ্যা প্রায় ৮৫ লাখ। তন্মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ১৫ হাজারের মত…
হন্ডুরাস সম্পর্কিত কিছু তথ্য
- হন্ডুরাস সেন্ট্রাল আমেরিকায় দ্বিতীয়তম সবচেয়ে বড় দেশ !
- ২০১৪ সালে হন্ডুরাস ফুটবল বিশ্বকাপে তাদের প্রথম গোলটি বাংলাদেশের নামে উৎসর্গ করার ঘোষনা দেয়।
- ১৯৬৯ সালে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে হন্ডুরাসের সঙ্গে এলসালভাদরের যুদ্ধ হয়, যা ‘ফুটবল ওয়ার’ নামে পরিচিত।
- হন্ডুরাসের জাতীয় পতাকার সাথে আর্জেন্টিনার পতাকার মিল রয়েছে।
- দেশটির প্রায় ৫০% জনগণই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন।
- হন্ডুরাসের মানুষরা ৭৪.৬ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকেন।
- ১৫০২ সালে ক্রিস্টোফার কলোম্বাস হন্ডুরাস আবিষ্কার করেন।
- হন্ডুরাস পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে ঘরের মধ্যেও সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ।
- পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ খুন হয় হন্ডুরাসে।
- আমেরিকার সর্বপ্রথম সিনেমা নির্মিত হয় হন্ডুরাসে !
- ভয়ংকর সব বিষধর সাপের বসবাস হন্ডুরাসে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য – The Green Palm Pit Viper, the Coral Snake এবং The Middle American Rattlesnake.
- হন্ডুরাসের ৯৪% মানুষের প্রধান ভাষা স্প্যানিশ । বাকি ৬% মানুষ আর্মেডিয়ান ভাষায় কথা বলে। তাছাড়া স্থানীয় কিছু উপভাষাও আছে।
- হন্ডুরাস বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্থ দেশের একটি।
- কফি উৎপাদনে হন্ডুরাস ৬ তম। বিশ্বের ২.৮ শতাংস কফির যোগান দেয় ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটি।
- বিশ্বের আটটি দেশের সংবিধান অনুসারে ধর্মীয় নেতারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। হন্ডুরাস তার মধ্যে একটি।
- দুই মসজিদের দেশ হন্ডুরাস। এখানে মাত্র দুটি মসজিদ রয়েছে। হন্ডুরাসে মুসলমানদের ইবাদতের জন্য মাত্র দু’টি মসজিদ রয়েছে। হন্ডুরাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সান পেড্রোসুলায় (San Pedro Sula) বৃহত্তম মসজিদটি অবস্থিত
হন্ডুরাসের যত অদ্ভুত কান্ডকারখানা
- বানর দেবতার শহর : এক হারানো শহরের নাম হলো ‘লা সিউদাদ ব্ল্যাংকা’ বা ‘The White City’, যাকে বানর দেবতার শহর বলা হয় (Lost City of the Monkey God)। জায়গাটি হন্ডুরাসের গুয়েতেমালার পশ্চিমে আর এল সালভাদরের দক্ষিণে অবস্থিত। লোকমুখে শোনা যায়, উক্ত পরিত্যক্ত শহরটির সন্ধানে যে যায়, সে আর ফিরে আসে না ! যদিওবা ভাগ্যবলে ফিরেই আসে, তবে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণটা সম্পর্কে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, ওই শহর অভিশপ্ত। বিশেষ করে সাদা চামড়ার অধিকারীরা ওইখানে গেলে আর রক্ষা নেই। রহস্যে ঠাঁসা ওই শহরটাতে কি এমন আছে, যা এমন কল্পকথার জন্ম দেয়? অনুসন্ধিৎসুদের মাথায় এই প্রশ্নটা বারবারই ঘুরপাক খায় বিধায় গত ৪০০ বছরে অনেকেই দলবেঁধে উক্ত শহরের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। কিন্তু বিধিবাম, কেউই শহরটির কোন সন্ধান পায়নি।
- ক্রিষ্টাল খুলি : ১৯২৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিচেল হজেস নামক এক ব্যক্তি হন্ডুরাসের জঙ্গলে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেন। জায়গাটার নাম ছিল ‘লুব্বাতুনের ধ্বংসস্তূপ’। এর আরেক নাম হচ্ছে পতিত পাথরের শহর। এটি ছিল প্রাচীন মায়া সভ্যতার লীলাভূমি। ধারণা করা হয়, কোনো দূর অতীতে আকাশ থেকে এখানে রহস্যময় পাথর পড়েছিলো। এখানে ৩ বছর একটানা খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়েছেন মিচেল। অবশেষে ৩ বছর পর একদিন প্রমাণ সাইজের একটি ক্রিস্টাল পাথরের খুলি আবিষ্কার করে মিচেলের অষ্টাদশী কন্যা অ্যানা। আর এর ঠিক ৩ মাস পর একই স্থানে খুলির সঙ্গে মানানসই একটি চোয়ালের হাড়ও খুঁড়ে বের করা হয়। খুলিটার প্রভাবে নানারকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ধারনা করা হয়, এটা পৃথিবীর কারো তৈরি নয়, দূর অন্তরীক্ষের কোনো উন্নত ভিনগ্রহবাসীর হাতের কাজ। কারো কারো মতে, মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ চালাতে পারে এই খুলি। এর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে পরাবাস্তব শব্দ, গন্ধ এমনকি ভৌতিক মূর্তি দেখা দিতে পারে। আবার অনেকে বলেন, বড়জোর পাথরটার সম্মোহনী ক্ষমতা পর্যন্ত। তবে রহস্যের আরেক প্রান্তে রয়েছে কী এক মাছঅভিশাপ। বাস্তব অনেক ঘটনা প্রমাণ করে ক্রিস্টাল খুলির সঙ্গে অভিশাপের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
হন্ডুরাসের মাছবৃষ্টি
হন্ডুরাসের লোকাচার বিদ্যায় মাছ বৃষ্টি একটি অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনা। এই অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে মে মাস থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি। প্রথমে আকাশে কালো মেঘ জমে। এরপর শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি, সেই সঙ্গে প্রবল বাতাস, বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রপাত। অবিরাম এই বৃষ্টির সাথে মাটিতে আছড়ে পরে অসংখ্য জীবন্ত মাছ। এরকম চলে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা। আর বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর শত শত জীবন্ত মাছ পড়ে থাকতে দেখা যায় মাটির ওপরে। লোকজন এসব মাছ কুড়িয়ে নিয়ে রান্না করে খায়।
১৯৯৮ সাল থেকে স্থানীয় লোকজন এ প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর উৎসবেরও আয়োজন করে। বৈজ্ঞানিক ধারণামতে, আটলান্টিক মহাসাগরে সংগঠিত টর্নেডো উঠিয়ে নিয়ে আসে এই মাছগুলো এবং ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হন্ডুরাসের ইউরো শহরে ফেলে। তবে প্রতিবছর একই সময় টর্নেডো আটলান্টিক মহাসাগর থেকে মাছ উঠিয়ে এনে ইউরোতেই ফেলবে এ ধরনের কাকতালীয় ঘটনা অনেকের মতে অসম্ভব।
অনেকের মতে, এ মাছগুলো স্বাদু পানির এবং সাঁতরে কাছের নদী কিংবা জলাশয় থেকে ভূগর্ভস্থ জলাধারে আশ্রয় নেয়। ভারী বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে গেলে মাছগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
আবার কারো কারো মতে, ১৮৫৬-১৮৬৪ সালে হন্ডুরাসে আসা এক সাধুর কারণে এ মাছ বৃষ্টি হয়। কথিত আছে, অনেক অভাবী লোক দেখে সেই সাধু তিন দিন, তিন রাত সৃষ্টিকর্তার কাছে অভাবীদের খাবারের চাহিদা মেটানোর মত কোনো অলৌকিক ঘটনার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। সেই অলৌকিক ঘটনাই হচ্ছে এই মাছ বৃষ্টি, এমনটাই তাদের বিশ্বাস !
হন্ডুরাসের খাবার দাবার
খাদ্যরুচির বিষয়ে হন্ডুরাস খুবই মার্জিত। তাদের খাবার দাবারের মধ্যে তেমন কোনো অদ্ভুত জিনিসই লক্ষ্য করা যায় না। আমেরিকানদের মতই সাদামাটা খাবার খেতে পছন্দ করেন তারা। বেলাদা, কার্নে আসাদা, সোপা দে ক্যারাকল হচ্ছে হন্ডুরাসের জাতীয় খাবার।
খাবারের ব্যাপারটা বাদ দিলে পরিশেষে বলতেই হয়, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক দেশ হন্ডুরাস !