গাঁজার লোভ দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট কিম উত্তর কোরিয়াকে হাতের মুঠোয় রেখেছেন ! এমন কথা শুনে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হবেন। গাঁজার জন্য একটা দেশের মানুষ তাদের প্রেসিডেন্টের এত পাগলামি মেনে নিবে, এটা বিশ্বাস করা যায়?
আগে চলুন দেখে নেয়া যাক প্রেসিডেন্ট কিমের পাগলামির নজিরগুলো। তারপর গাঁজার প্রসঙ্গে আসছি…
প্রেসিডেন্ট কিম এর বানানো যত অদ্ভুত নিয়ম
ইন্টারনেট ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, এমন একটি দেশে আপনি কতদিন বাস করতে পারবেন? যেখানে নেই কোনো টিভি চ্যানেল, নেই কোনো রেডিও স্টেশন ! যেখানে কোনো প্রকার সিনেমা দেখা বা গান শোনা নিষিদ্ধ। চুল কাটতেও লাগে সরকারি পারমিশন !
অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কিসব গাঁজাখুরি কথা বকে যাচ্ছি ! জ্বী না, গাঁজাখুরি নয়। এরকম দেশের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে। এবং সেখানে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দিব্যি বসবাস করছে। হ্যাঁ, বলছি আমাদের পরিচিত দেশ উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে। যে দেশের আইন-কানুন শুনলে আপনি শুধু অবাক না, বরং অধিক শোকে পাথর হয়ে যাবেন !
একনায়কতান্ত্রিক দেশ উত্তর কোরিয়া। পারমাণবিক শক্তিধর দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। মিডিয়ার কাছে তার খ্যাতি আছে পাগলাটে নেতা হিসেবে। উত্তর কোরিয়ায় যেসব মনগড়া আইন তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
১. উত্তর কোরিয়া’র ইতিহাস বইতে শুধু কিমজং ১ এবং কিমজং ২, এই দুইজনেরই বীরগাঁথা পড়ানো হয়ে থাকে। অন্য দেশ বা বাকি দুনিয়ার ইতিহাসের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই।
২. উত্তর কোরিয়া’র নারী সম্প্রদায় আমাদের দেশের মত সিরিয়াল অ্যাডিকশন থেকে মুক্ত। কারণ সেখানকার টিভি চ্যানেলে চ্যানেলের সংখ্যা মাত্র তিনটি ! সরকার স্বীকৃত এই চ্যানেলগুলোর একটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় এবং বাকি দুইটি সপ্তাহে একবার করে চালু করা হয়। এবং সেখানে শুধুই সরকার দলের গুণকীর্তণ দেখানো হয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট কিম এর নিজস্ব ছবি দেখার প্রেক্ষাগৃহে রয়েছে প্রায় বিশ হাজার সিনেমার কালেকশন, যার বেশিরভাগই পশ্চিমা !
৩. উত্তর কোরিয়া’য় গান গাইতেও অনুমতি লাগে। এ দেশের মানুষের গান শোনা এবং গাইতে মানা। প্রতিটি ঘরে রেডিও থাকা বাধ্যতামূলক, যেখানে আপনি শুধুমাত্র এই দেশের জাতীয় সঙ্গীতই শুনতে পারবেন। কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে আপনি নিজের মত গান গাইবেন, সে সুযোগ নেই। গান হতে হবে দেশ এবং কিম জং এর বন্দনামূলক এবং সরকারকর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত। যদিও প্রেসিডেন্ট কিম নিজে সঙ্গীতচর্চা করেন। তাঁর রয়েছে প্রায় ৩ ডজন পিয়ানো !
৪. উত্তর কোরিয়া’য় চুল কাটারও রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম। নিজের মনমত চুল কেটে সেলিব্রেটিদের স্টাইল নকল করে মেয়ে পটানোর সুযোগ উত্তর কোরিয়ার ছেলেদের নেই। ছেলেদের জন্য রয়েছে চুল কাটার ২৮টি নির্দিষ্ট নিয়ম। ২০১৩ সালে করা চুল কাটার এ নিয়ম অনুযায়ী ছেলেদের জন্য ২৮টি এবং মেয়েদের জন্য ১৮টি নির্দিষ্ট হেয়ারকাটিং স্টাইল রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় ছেলেদের চুল স্পাইক করাও নিষেধ।
৫. উত্তর কোরিয়া’য় শিক্ষিত হতে কোনো পড়াশোনা করা লাগেনা । এ দেশের কোনো নাগরিক শুদ্ধভাবে কিম শাং ইন লিখতে পারলেই তাকে শিক্ষিত বলে গণ্য করা হয়।
৬. সবরকমের ধর্ম উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ ! উত্তর কোরিয়া একটি নাস্তিক দেশ হওয়ায় এখানে সকল প্রকার ধর্মীয় বই, উপাসনালয় এবং ধর্মীয় উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন ভঙ্গকারীর জন্য রয়েছে কঠিন সাজা। তাকে যেতে হবে লেবার ক্যাম্পে।
৭. উত্তর কোরিয়া’য় নেই কোন খবরের কাগজ ! এখানকার মানুষরা বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জীবনযাপন করে। এখানে পড়ার জন্য খবরের কাগজও সহজে পাওয়া যায় না। সেজন্য বাসস্ট্যান্ড বা রেলওয়ে স্টেশনে খবরের কাগজের কপি লাগানো হয়। এবং তা পড়ার জন্য মানুষজনকে সেইখানে যেতে হয়। এমনকি বাইরের কোনো দেশের মানুষদের সাথেও তারা যোগাযোগ করতে পারে না। বিদেশে কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলেও না !
৮. কেউ মারা গেলে আমরা তার জন্য কিছুক্ষণ বা কিছুদিন কান্নাকাটি করি। কিন্তু উত্তর কোরিয়ায় কান্নাকাটির উপরেও আছে বিধিনিষেধ। এখানে নির্দিষ্ট দিন থাকে কান্নাকাটি করার জন্য। এছাড়া কোনো শোক দিবসেও সকলকে একত্রিত হয়ে কান্নাকাটি করতে হয়। এবং সেই কান্না সত্যিকার হতে হবে। আপনি ভং ধরে বসে থাকলে এবং সেটা ধরা পড়লে আপনাকে যেতে হবে লেবার ক্যাম্পে !
৯. উত্তর কোরিয়া ইন্টারনেট বিহীন একটি দেশ। আপনি যদি ভেবে থাকেন ইন্টারনেট ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেনা, তাহলে আপনার ধারণা ভুল। যেকোনো দেশে যেখানে একঘন্টার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়বে, সেখানে উত্তর কোরিয়ায় মানুষ ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই দিব্যি দিন কাটাচ্ছে। সরকারি কিছু কাজ বাদে এদেশে অন্যদের ইন্টারনেট ব্যাবহার করা নিষেধ। দিনে কিছুটা সময় হয়ত আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু আপনাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে সরকার নির্ধারিত এক হাজার ওয়েবসাইটে। যেখান থেকে আপনি জানতে পারবেন কিম জং উন কখন কি করছেন, কি খাচ্ছেন, কয়বার বাথরুমে যাচ্ছেন এসব !
১০. উত্তর কোরিয়ায় কোনো ছাড় নেই পর্নোগ্রাফিতে ! পর্নোগ্রাফি এদেশে ভয়াবহভাবে নিষিদ্ধ। এ ধরনের কোনো ভিডিও দেখা অবস্থায় ধরা পড়লে আপনার মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে। কোরিয়ান সরকার এ পর্যন্ত প্রায় ১২ জন পর্নতারকাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। এমনকি ন্যুড ভিডিও বের করায় দেশটিতে ২০১৩ সালে ১২ জন পপ সঙ্গীত শিল্পীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
১১. উত্তর কোরিয়ায় ষ্কুল চালায় অভিভাবকরা। সাধারণত ষ্কুল থেকে বেতন নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের সেবা শিক্ষা দেওয়ার জন্য। বেঞ্চ, টেবিল এগুলো ষ্কুল থেকেই দেওয়া হয়। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ভিন্ন। এখানে বেতন দেওয়ার পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষে নিজ ছেলে মেয়ের জন্য ডেস্ক-টেবিল, চেয়ারও অভিভাবককেই সরবরাহ করতে হয় !
১২. উত্তর কোরিয়ায় জিন্সের প্যান্ট নিষিদ্ধ। উত্তর কোরিয়ার সাথে আমেরিকার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আর নীল জিন্সকে মনে করা হয় আমেরিকান পোষাক। তাই উত্তর কোরিয়ায় নীল রঙের জিন্স পড়াও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
এছাড়াও উত্তর কোরিয়া’য় রয়েছে আরো অনেক অদ্ভূত নিয়ম কানুন। এখানে ট্যুরিষ্টদের একা ঘুরা নিষেধ। নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া নিষেধ। এদেশে থাকতে হলেও লাগে সরকারি পারমিশন। এমনকি ছবি তোলার উপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কোনো ট্যুরিস্ট গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে সেখানে যেতে পারলেও ছবি তুলতে পারবেনা। ছবি তুললেই তাকে আটকা পরতা হবে উত্তর কোরিয়ার জেলে !
আইন অমান্যকারীর জন্য যে ‘লেবার ক্যাম্প’ এর কথা বলা হয়েছে, সেটা হল এক ধরনের জেলখানা। যেখানে অপরাধীদের দিয়ে সকল নিম্নশ্রেণীর কাজ করানো হয়…
এখন কথা হলো, এত অপরাধী সরকার কোথায় পায়? প্রতিনিয়ত এত অপরাধী ধরা সম্ভব না, তাই কিম জং উন এক্ষেত্রে আরেকটি অদ্ভূত নিয়ম বানিয়েছেন। যে নিয়মে যেকোনো প্রকার অপরাধে যাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে, তার অপরাধের সাজা শুধু সে নয়, বরং তার ছেলে এবং নাতি সহ তিন পুরুষ সেই সাজা ভোগ করবে !
ক্ষমতায় থাকা নিয়ে কিম খুব সন্দিহান। প্রতি পাঁচ বছর পর পর এদেশে ভোট আয়োজন করা হয়, যেখানে একমাত্র কিমই ভোটে দাঁড়াতে পারেন। তাই অবধারিতভাবে প্রতিবার জনগণের কিমকেই ভোট দিতে হয়। মানুষ যেনো তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারে, সম্ভবত সেজন্যই কিম এসকল মনগড়া আইন জারি করে এবং সামান্য অপরাধেই কঠিন শাস্তি দেয়, যেনো আর কেউ আইন ভাঙার সাহস না করে !
বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহ হওয়ায় নিজের চাচাকে পর্যন্ত কিম ১২০টি ক্ষুধার্ত কুকুরের মাঝে ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন।
অলিম্পিক হারায় শাস্তি পাচ্ছে উত্তর কোরিয়া’র প্লেয়াররা !
সামান্য কারণেই শাস্তি দেবার ঘটনা কিমের জন্য এটাই শেষ না। অলিম্পিকে পদক না পাওয়ায় তিনি অলিম্পিক প্রতিযোগীদের পর্যন্ত শাস্তি দিয়েছেন। ২০১৬ সালে ব্রাজিলের রিওতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে কিম চেয়েছিল পাঁচটি স্বর্ণ সহ ১২টি অন্যান্য পদক। যেখানে উত্তর কোরিয়া থেকে অংশগ্রহণ করা ৩১ জন প্রতিযোগী দুটি স্বর্ণসহ পাঁচটি অন্যান্য পদক পেতে সক্ষম হয়। এখন সেই সকল প্রতিযোগীরা লেবার ক্যাম্পে তাদের তিন পুরুষ নিয়ে শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছে।
২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপের কথা মনে আছে? যেখানে পর্তুগালের কাছে উত্তর কোরিয়া ৭:০ গোলে হেরেছিলো। সেই টিমের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে শাস্তি পেতে হয়েছে।
জনগণ কেনো এত অত্যাচার মেনে নিচ্ছে?
নিশ্চয়ই ভাবছেন গোটা একটা দেশের জনগণ বছরের পর বছর এই অত্যাচার কিভাবে সহ্য করছে ! কেনো তারা আন্দোলন করে কিমকে ক্ষমতাচ্যুত করছে না?
উত্তরটা হলো, গাঁজা !
হ্যাঁ, গাঁজার নেশাতেই এই জাতিকে এত বছর পর্যন্ত দমিয়ে রেখেছে চতুর প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। অন্যান্য সকল খুঁটিনাটি বিষয়ে বাধ্যবাধকতা থাকলেও এদেশে গাঁজা খাওয়া সম্পূর্ণ বৈধ। এখানে গাঁজা খাওয়াটাকে চা খাওয়ার মত সাধারণ বিষয় হিসেবেই ধরা হয়।
কে জানে, হয়ত গাঁজার নেশায় মাতাল এই জাতি এসব অদ্ভূত নিয়ম কানুন মেনে নিয়ে বেশ শান্তিতেই বসবাস করছে।
আরো পড়ুনঃ