মান্না দে’র বিখ্যাত কফিহাউজ গানটি শুনেনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ গানের কথা, সুর আর গীতিরূপ এতটাই আকর্ষনীয় যে, চোখ বন্ধ করলেই গানে বর্ণিত চরিত্রগুলো কল্পনায় ভেসে উঠে। কফি হাউজের একটা টেবিলে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের সাতজন একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে ! কিন্তু কোথায় এই কফিহাউজ, কি তার ইতিহাস, কেনোই বা এত বিখ্যাত এই কফিহাউজ? এই প্রশ্নগুলো যদি কখনো আপনার মনে দাগ কেটে থাকে, তাহলে এই পোস্ট আপনার জন্যেই…
কফি হাউজের অবস্থান কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের ঠিক সামনেই। যদিও সবাই ওই রোডটাকে কলেজ স্ট্রীট বলে ডাকে, কিন্তু পারতপক্ষে ওই রাস্তার আসল নাম বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় লেন…
১৮৭৬ সালের এপ্রিলে সরকারি উদ্যোগে ‘অ্যালবার্ট হল’ নামে একটা ক্যাফে চালু হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো কলেজ স্ট্রিটে আসা যাওয়া করা প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের আড্ডা এবং তাদের কাছে হালকা খাবার দাবার বিক্রি করা। খুব অল্প সময়েই জমজমাট হয়ে ওঠে অ্যালবার্ট হল এবং মুখে মুখে নাম ছড়িয়ে যায় কোলকাতার আনাঁচে-কাঁনাচে। ১৯৪৭ এ ইংরেজদের হাত থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জনের পর কেন্দ্রীয় সরকার এ্যলবার্ট হলের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেয় ‘দ্য ইন্ডিয়ান কফিহাউজ’। এরপর থেকে কফিহাউজ নামটাই লোকমুখে ছড়িয়ে যায়।
দেশ বিভাগের পর কলেজ স্ট্রিটে ইউনিভার্সিটি অফ কলকাতা, প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়াও নতুন বেশ কয়েকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এছাড়াও ওই অঞ্চলে আছে পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার। যার ফলে ছাত্র-শিক্ষক ছাড়াও লেখক কবি সাহিত্যিক এবং সাহিত্যানুরাগী জনগণের মূল আড্ডাস্থল হয়ে ওঠে কফিহাউজ। বাংলা ভাষা কেন্দ্রীভূত অনেক বড় বড় শিল্পীর পা পরেছে এই কফিহাউজে। সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, মৃণাল সেন, অপর্না সেন, ঋত্বিক ঘটক, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম।
কত শত গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিংবা সিনেমার পিছনে যে লুকিয়ে আছে এই কফিহাউজের আড্ডা তার হিসেব করার চেষ্টাই বৃথা। বিংশ শতাব্দীর ৬০-৭০ এর দশকের বেশকিছু লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম এই কফিহাউজে। অগণিত আন্দোলনের শুরু এবং শেষ দেখেছে এই কফি হাউজের দেয়ালগুলো। ‘হাংরি জেনারেশন’ প্রকাশের অপরাধে কবি ভাতৃদ্বয় মলয় রায় চৌধুরী এবং সমীর রায় চৌধুরীদের গ্রেফতার করা হয়েছিলো এই কফিহাউজ থেকেই।
যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজস্ব জৌলুশ হারিয়েছে কফি হাউজ ! একদিকে বেড়েছে খাদ্যের তালিকা ও দাম, অন্যদিকে কমেছে সেবা এবং খাবারের মান। প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক কফিহাউজের পরিচর্যাও হয়নি সুষ্ঠুভাবে। অব্যবস্থাপনার কারণে ২০০৬ সালে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিলো কফি হাউজ । পরে কয়েকটা ব্যাক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির সাহায্য ও অনুদান নিয়ে কোনোমতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে কালের সাক্ষী এই আড্ডাকেন্দ্রটি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘কফিহাউজ’ গান গেয়ে এত সুনাম কুড়ানো গায়ক মান্না দে নিজে কখনো কফিহাউজ দর্শন করেননি !
গানটি ইউটিউব থেকে আরেকবার শুনে ফেলতে পারেন এই পোস্টটা পড়ার সাথে সাথেই…