গ্যারিঞ্চা ! ব্রাজিল ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করে রাখা এক নাম। বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসেও তার অবস্থান প্রথম ১০ জনের কাতারে। পরপর ২ বার ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দেয়ার জন্য গারিঞ্চা পালন করেছিলেন অনবদ্য ভূমিকা। গোল করানো তার কাছে ছিলো সহজলভ্য বিষয়। বিপক্ষ দলের রক্ষণ ভাগকে একাই নিজের জাদুতে ধ্বংস করে দিতেন। তার ড্রিবলিং করার মোহনীয় দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যেত না। ৫ ফুট সাড়ে ৬ ইঞ্চি এর মাঝারি গড়নের এই খেলোয়াড় ফুটবল নৈপুন্য দিয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে। লোকমুখে সমাদৃত হয়েছিলেন ফুটবলের চার্লি চ্যাপলিন নামে !
এবার ফুটবলের এই জাদুকর এর ব্যক্তিগত ও খেলোয়াড়ি জীবন সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক কিছু তথ্য…
গ্যারিঞ্চা, পুরো নাম ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো দস্ সান্তোস অক্টোবর ২৮,১৯৩৩ সালে পাউ গ্রান্ডি (আরজে) ব্রাজিলে জন্মগ্রহণ করেন। পূর্ব পুরুষেরা দাস, বাবা মাতাল, পারিবারিক আয় রোজগার নেই বললেই চলে। এমন এক বিরূপ সামাজিক পরিবেশে ১৯৩৩ সালের ২৮ অক্টোবর ব্রাজিলের পাঁউ গ্রান্ডিতে জন্মগ্রহণ করেন গ্যারিঞ্চা। খুব ছোটবেলায় পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর পা বাঁকা হয়ে যায় এবং ডান পায়ের তুলনায় বাম পা ৬ সে.মি. ছোট হয়ে যায়। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে কারখানায় কাজ নেন; যেখানে কারখানার মালিকের দলের হয়ে খেলার জন্য তিনি পেতেন খাবার আর মদ।
ব্যক্তিগত অনীহার কারণেই পেশাদার ফুটবলে আসতে তার কেটে যায় অনেক টা সময়। ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপে তার উইঙ্গার পজিশনে জুলিনহো কে অধিক যোগ্য মনে করায় বাদ পড়েন গ্যারিঞ্চা। তবে ১৯৫৮ সালে ব্রাজিল ফুটবল এসোসিয়েশন দ্বিতীয়বার একই ভুল করতে চাননি। প্রথম ২ ম্যাচে সুযোগ না পেলেও মাঠে নামেন তৃতীয় ম্যাচে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিপক্ষে এই ম্যাচে সর্বপ্রথম পেলে ও গ্যারিঞ্চা একসাথে মাঠে নামেন। এই ম্যাচের শুরু থেকে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে ব্রাজিল। খেলার প্রথম তিন মিনিটেই গ্যারিঞ্চার একটি ও পরে পেলের আর একটি শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ফুটবল ইতিহাসে এই তিন মিনিটকে বলা হয় “দ্যা গ্রেটেস্ট থ্রি মিনিটস অফ ফুটবলিং হিস্টোরি”। মজার এবং বিস্ময়কর বিষয় হলো পেলে ও গ্যারিঞ্চা মাঠে একত্রে থাকাকালীন সময়ে ব্রাজিল কে কোন ম্যাচই হারতে হয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিপক্ষে সেই ম্যাচের পরে আর ব্রাজিল দলের সাইড বেঞ্চে বসতে হয়নি গ্যারিঞ্চাকে। ফাইনালে সুইডেনের সাথে ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলকে ২-১ গোলে জিতিয়ে এনে দেন শিরোপা।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের পরে ১৯৬২ বিশ্বকাপের আগে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত গ্যারিঞ্চাকে নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিলো। বাবার মৃত্যুতে গভীর শোক থাকা সত্ত্বেও দলের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ৬২ সালের বিশ্বকাপে ২য় ম্যাচে পেলে ইঞ্জুরিতে গেলে দলের ভার আসে তার উপর। কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ইংল্যান্ড ও সেমিফাইনালে স্বাগতিক চিলির বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার বাঁকানো সেই গোল আজও ভক্ত সমর্থকেরা মনে রাখে “বেনানা শট” নামে। ফাইনালের প্রতিপক্ষ যুগোস্লাভিয়া কিন্তু ব্রাজিল দলের প্রাণ গ্যারিঞ্চার তখন গায়ে অনেক জ্বর। সেই জ্বর নিয়েই দলকে জেতালেন ৩-১ গোলে। ইতালির পর পরপর দুই আসরে বিশ্বকাপ জয়ের খেতাব পেল ব্রাজিল। আর ব্রাজিলের এই কীর্তির মূল নায়ক ছিলেন গ্যারিঞ্চা।
১৯৬৬ এর বিশ্বকাপে গ্যারিঞ্চার ফিটনেস এবং গোড়ালিতে ইঞ্জুরি দেখা দেয়। ইঞ্জুরি স্বত্ত্বেও তিনি প্রথম ম্যাচে মাঠে নামেন এবং এক গোল করে দলকে জিতিয়ে আনেন। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচ ব্রাজিল ১-৩ গোলে হেরে যায়। যা ছিল গ্যারিঞ্চার ব্রাজিল দলের হয়ে প্রথম হার এবং একই সাথে শেষ ম্যাচ। এরপর ১৯৬৬ এর বিশ্বকাপে ব্রাজিল গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে।ক্যারিয়ার এ ৫০ ম্যাচে ১ টি মাত্র ম্যাচে তিনি ছিলেন পরাজিত। গোল করেছেন ১২ টি। তবে দলের সারথিদের কে দিয়ে গোল করিয়ে বিপক্ষ দলকে দেউলিয়া করেছেন ক্যারিয়ার এর সবটুকু সময়।
সব ধরনের ফুটবল থেকে ১৯৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর অবসর নেন গারিঞ্চা। এর পেছনে কারণটি ছিল মজার। ১৯৭৩ সালে তার বয়স যখন ৪০ বছর তখন তিনি ইতিমধ্যে “নানা” হয়ে গিয়েছিলেন। তখন গারিঞ্চার মনে হল যে নানা হয়ে যাওয়ার পরে তার আর ফুটবল খেলা মানায় না। তাই তিনি সব ধরনের ফুটবল থেকে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু ব্রাজিলের দুইটি বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক গারিঞ্চাকে কি আর সাদামাটাভাবে বিদায় দেয়া যায়। তাইতো ১৯৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য মারাকানা স্টেডিয়ামে বিশ্ব একাদশ বনাম ব্রাজিলের ম্যাচ আয়োজন করে। সেখানেই ভক্তদের কাছ থেকে বিদায় নেয় লেজেন্ড গ্যারিঞ্চা।
ব্রাজিলের মানুষের কাছে “পিপলস জয়” আর “বেন্ট লেগ এঞ্জেল” খ্যাত গ্যারিঞ্চা ব্যক্তিগত পর্যায়ে জিতেছেন অনেক ট্রফি। ১৯৬২ বিশ্বকাপে জিতেছেন একই সাথে গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট। ব্রাজিলের হয়ে খেলেছেন ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত “ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ অল টাইম টিম” এ স্থান পেয়েছেন। ১৯৬২ সালে জিতেছেন ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ পুরষ্কার ব্যালন ডি’অর সহ ছোট বড় অসংখ্য ট্রফি। ফুটবলের এই মহান বোদ্ধা ১৯৮৩ সালের ২০ জানুয়ারী লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান
গ্যারিঞ্চা ব্রাজিল ফুটবলের জন্য রেখে গেছেন অনেক সম্পদ।তার দেখানো ড্রিবলিং, ছন্দময় ফুটবল,আনন্দের সাথে খেলা সবই বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিদর্শন। তার দেখানো পথেই পরবর্তী সময়ে হেটেছেন ব্রাজিল এর সক্রেটিস, রোমারিও, রিভালদো, রোনালদিনহো, কাকা ও বর্তমানের নেইমার। ব্রাজিল এবং বিশ্ব ফুটবলে “গ্যারিঞ্চা” এক স্বপ্নপুরুষ, আলোর দিশারি। কোটি মানুষের মাঝে বেচে থাকুক ক্ষণজন্মা এই ফুটবল জাদুকর।