তেলাপোকা খাওয়া আপনার কাছে জঘন্য একটি ব্যাপার মনে হতে পারে। কারণ আমাদের সমাজে খাবার হিসেবে কখনোই পোকামাকড়কে খুব একটা গুরুত্বের চোখে দেখা হয়নি। আমরা এগুলোকে সবসময় সৃষ্টির অভিশাপ এবং নোংরা জীব হিসেবেই অভিহিত করে আসছি। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, আমাদের এশিয়া মহাদেশেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তেলাপোকা খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এমনকি না জেনে আমরাও তেলাপোকা দিয়ে প্রস্তুতকৃত অনেক ওষুধ খাচ্ছি !
হ্যাঁ, তেলাপোকা একটি ভোজ্য প্রাণী এবং এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর। যদি সঠিক নিয়মে পরিষ্কার করে রান্না করা হয়, তাহলে একটি তেলাপোকাই আপনাকে এক প্লেট ভাতের চেয়ে বেশি পুষ্টির জোগান দিবে।
খাবার হিসেবে তেলাপোকা
তেলাপোকা খাওয়ারও কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। তেলাপোকা কাঁচা খাওয়ার জিনিস নয়। মুরগির মাংস আপনি যেভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে রান্না করে খান। তেলাপোকা খেলেও ঠিক সেই নিয়মেই রান্না করে খেতে হবে। যাতে এর গায়ে থাকা ব্যাকটেরিয়া মরে যায়।
তেলাপোকা খাওয়ার জন্য সবচেয়ে সুন্দর নিয়ম হচ্ছে একে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিয়ে সরাসরি গরম তেলে ভেজে ফেলা। এতে পোকাটি খেতে চিপসের মত মচমচে স্বাদ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরুপ আমরা থাইল্যান্ডের কথা বলতে পারি। থাইল্যান্ডে স্থানীয় নানান রকম খাবারের সাথে মচমচে তেলাপোকা, ফড়িং ও ঝিঁঝিপোকা পরিবেশন করা হয়। স্ট্রীট ফুড হিসেবেও সেখানে পোকামাকড় বেশ জনপ্রিয়। আমরা রাস্তার পাশে যেমন পুরি পেঁয়াজু বেগুনি কিনে খাই, ঠিক তেমনি থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম সহ আরো কয়েকটি দেশের রাস্তায় সারি সারি খাবারের দোকান পাওয়া যায়। সেসব দোকানে পরিবেশনকৃত প্রধান খাবার হচ্ছে হরেক রকমের পোকামাকড় !
একটা আসলে একটা সুন্দর আইডিয়া। আপনার দেশে প্রচুর পরিমাণ পোকামাকড় পাওয়া যায়। পোকামাকড়ের যন্ত্রণায় আপনি ঘরবাড়ি ঠিকঠাক রাখতে পারছেন না। যেহেতু হাতের কাছে এত পুষ্টির সংস্থান পাওয়াই যাচ্ছে, তাহলে আপনি সেটা ফেলে দিবেনই বা কেনো?
ঠিক এই কারণেই ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীন সহ বেশ কয়েকটি দেশ তেলাপোকা সহ অন্যান্য কিছু পোকাকে খাবার যোগ্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কম্বোডিয়ায় মাকড়শার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, তারা এখন প্রতিদিন সকালের নাস্তায় গরম তেলে ভাজা বাটিভর্তি মাকড়শা খায়। এতে তাদের বাড়তি নাস্তা কেনার খরচ বাঁচে !
চীনে তেলাপোকার ফার্ম রয়েছে। ফার্মের মালিক একসময় তেলাপোকা ভয় পেতেন। এখন তিনি নিজেই সেখানে তেলাপোকা চাষ করেন। এবং মরে যাওয়া তেলাপোকা গুলো সংগ্রহ করে বিকেলের নাস্তায় স্ন্যাকস হিসেবে খান !
ওষুধ হিসেবে তেলাপোকা
ঠিক এই মুহূর্তে এসব খাবার দেখলে আমরা হয়ত তাদেরকে অসভ্য জাতি বলে তাদের সংস্কৃতিকে নিন্দা করে বসবো। কিন্তু এমনটা ভাবা আসলেই উচিত নয়। কারণ জেনে অবাক হবেন, ডাক্তারের পরামর্শে আমরা যে সমস্ত ওষুধ খাই, তার অধিকাংশই প্রস্তুত করা হয় নানান রকমের পোকামাকড়ের দেহ থেকে সংগ্রহিত রসদ থেকে !
E. coli এবং MRSA নামক ভয়ংকর দুটি ব্যাকটেরিয়ার ওষুধ তেলাপোকার ছোট্ট মাথা থেকে প্রস্তুত করা হয়। তেলাপোকার দেহ থেকে নির্গত রস ব্যবহার করে এন্টিবায়োটিক ও পেনিসিলিন তৈরি করা হয়।
মাংস থেকে কয়েকশ গুণে সস্তা, কিন্তু একই পরিমাণ প্রোটিন যুক্ত খাবার হচ্ছে পোকা। জেনে অবাক হবেন, পুরো পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০% মানুষ প্রতিদিন নিজের তিনবেলা খাবারের জন্য খরচ করতে পারছেন মাত্র ১৬০ টাকা। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সমাজের সব স্তরের লোকেদের জন্য মাংস কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। এশিয়ার এমনই কয়েকটি দেশে নিম্মআয়ের লোকদের পুষ্টির চাহিদা পুরণ করছে তেলাপোকা, মাকড়সা, লারভা সহ অন্যান্য পোকাগুলো !
যেসব কারণে আমরা পোকামাকড় খাইনা
ইসলাম ধর্ম অনুসারে পোকামাকড় খাওয়া আমাদের জন্য হারাম। মূলত এ কারণেই আমরা পোকামাকড় সহ আরো কিছু অতিমাত্রার খাবার এড়িয়ে চলি। এছাড়াও বহুকাল ধরে এই রীতিই আমাদের সমাজে চলে এসেছে। মাছে ভাতে বাঙ্গালী হিসেবে সুনাম কামানো আমাদের খাবারের দৌড় ভাত মাছ মাংস আর শাকসবজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ কারণে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় খাবারের দিক থেকে আমরা কিউট জাতি !
তেলাপোকা সম্পর্কে মজার কিছু তথ্য
- দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর সাতদিন পর্যন্ত একটি তেলাপোকা বেঁচে থাকে।
- একটি তেলাপোকা প্রায় ৪০ মিনিট পর্যন্ত নিঃশ্বাস ধরে রাখতে পারে। অর্থাৎ পানির নিচে চাপা পরা অবস্থায়ও এটির ৪০ মিনিট পর্যন্ত বেঁচে থাকা সম্ভব।
- একটি তেলাপোকা ঘন্টায় তিন মাইল পর্যন্ত হাঁটতে পারে।
- জার্মানীর তেলাপোকারা মাত্র ৩৬ দিনেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়।
- সদ্য জন্ম নেয়া তেলাপোকারা তাদের বাবা মার মতই একই গতিতে চলতে বা দৌঁড়াতে পারে।
- আমেরিকান তেলাপোকারা বিয়ার, মদ বা অ্যালকোহল দেখলেই ঝাপিয়ে পরে। আমেরিকানরা তেলাপোকার ভয়ে ভুলেও মদের বোতল খোলা রেখে অন্য রুমে যায় না।
- পৃথিবীতে সর্বপ্রথম তেলাপোকার আগমণ ঘটেছিলো প্রায় ২৮০ মিলিয়ন বছর পূর্বে।
- পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৪০০০ প্রজাতির তেলাপোকা আছে।
- শীতল রক্তের প্রাণী হিসেবে পরিচিত তেলাপোকারা খাবার ছাড়া ৪০দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তবে পানি ছাড়া এরা বাঁচতে পারে মাত্র ৭দিন পর্যন্ত !
আমাদের দেশে তেলাপোকা একটি নোংরা ও ঘৃণিত প্রাণী। আমাদের পরিবেশ ও পারিপাশ্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে অবশ্যই এদেরকে পোকামাকড়ই ভাবা উচিত। বিয়ের পর বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ঘরবাড়ি তেলাপোকা মুক্ত রাখা। ঠিক এই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমাদের চলা উচিত। তবে অবসর কাটাতে কখনো থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীন বা কম্বোডিয়ায় গেলে এক পিস তেলে ভাজা মচমচে তেলাপোকা খেয়ে আসলে মন্দ হবেনা !
আরো পড়ুনঃ