সিনেমায় আমরা সবাই কমবেশ একটা দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত, বহুকাল আগে নায়কের বাবা মাকে ভিলেন মেরে ফেলেছিলো। সেই নায়ক বড় হয়ে একসময় ভিলেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দেয় ! পেস্ট্রি যুদ্ধ নিয়ে লিখতে গিয়ে বাড়তি দুটো কথা বলতেই হচ্ছে। কারণ ধরা যাক ব্যাপারটা এমন হলো, বহু বছর আগে ভিনদেশী এক নাগরিকের পেস্ট্রির দোকানে ঢুকে স্থানীয় ডাকাত/লুটেরারা সব পেস্ট্রি খেয়ে ফেলেছিলো। এখন সেই পেস্ট্রির দোকানের মালিক যে দেশের নাগরিক, সেই দেশ বহু বছর পরে অপর দেশটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে চাচ্ছে। কেমন অদ্ভুত না ব্যাপারটা?
ইতিহাসের এমনই এক অদ্ভুত যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত ‘পেস্ট্রি যুদ্ধ’ ! দুই দেশের মধ্যে পাঁচমাস যাবৎ চলা অদ্ভুত এ যুদ্ধ নিয়ে আমাদের আজকের এই পোস্ট !
পেস্ট্রি যুদ্ধ : ঘটনার শুরু যেভাবে
মেক্সিকান রিপাবলিকের শুরুর ইতিহাস তেমন একটা সুবিধাজনক ছিলো না। কথায় কথায় সেখানে সামরিক শাসন জারি করা হতো। কারফিউ, গণ অভ্যুত্থান এগুলো ছিলো তাদের কাছে বাথরুমে আসা যাওয়ার মত নিত্যদিনের ঘটনা। এই অস্থির সময়ে সেখানকার ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা স্থাপনা ইত্যাদির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো। সবচেয়ে বেশি ভুগেছিলেন বিদেশী নাগরিকেরা, যারা লুটপাট এবং ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মেক্সিকো সরকারের তেমন কোনো করুণার দৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হননি।
১৮২৮ সালে মেক্সিকোর এমন এক সামরিক গণ অভ্যুত্থানের সময়ে কিছু লুটেরা রেমোঁতেল (Remontel) নামক এক ফরাসী নাগরিকের পেস্ট্রির দোকানে ঢুকে হামলা চালায়। তারা সেখানে ঢুকে প্রথমে দোকানের সব পেস্ট্রি খেয়ে শেষ করে। তারপর ক্যাশবক্স লুটপাট করে। এবং সবশেষে বেরিয়ে যাবার সময় দোকান ভাংচুর করে যায়।
রেমোঁতেল মেক্সিকো সরকারের কাছে অভিযোগ করেন এবং ক্ষতিপূরণ চান। কিন্তু মেক্সিকো সরকার তার অভিযোগ আমলে নেয়নি। এরপর রেমোঁতেল তার নিজ দেশ ফ্রান্সের সরকারের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু সেটাও ফ্রান্সের সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
এখানে ‘দৃষ্টিগোচর হয়নি’ বলতে বুঝাতে চাচ্ছি, একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগপর্যন্ত ব্যাপারটা ফ্রান্সের সরকারের নজরে পড়েনি। এই সময়টা ছিলো প্রায় দশ বছরের মত। দীর্ঘ দশবছর পর যখন রেমোঁতেলের অভিযোগটায় তাদের চোখ পড়লো, তখনই শুরু হলো ভিন্ন কাহিনী !
যেভাবে বাঁধলো পেস্ট্রি যুদ্ধ
দশবছর পর ফ্রান্সের রাজা ‘লুই ফিলিপ’ তার কোষাগারের সব টাকাপয়সা গুনতে বসলেন। গুনতে গিয়ে দেখলেন, মেক্সিকো সরকারের কাছে ফরাসী সরকারের অনেক অর্থ পাওনা রয়েছে। মেক্সিকো সরকার বিভিন্ন সময় ফ্রান্সের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিলো। কিন্তু এত বছরেও সেই টাকার একটি অংশও ফেরত দেয়নি। বরং সেসব ধার করা টাকাপয়সা দিয়ে তারা নিজেদের বিরোধীদল গুলোকে ঘায়েল জন্যে অস্ত্রশস্ত্র কিনে, সামরিক বাহিনী তৈরি করে মেক্সিকোতে বেশ জমজমাট অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
রাজা ফিলিপ তার পাওনা অর্থ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। যে হারে মেক্সিকোতে মারামারি-কাটাকাটি চলছে, তাতে তিনি তার পাওনা টাকা ফিরে পাবেন কিনা, সেটা নিয়ে তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো। মেক্সিকো সরকারকে তিনি কয়েকবার তাগাদাও দিলেন ফ্রান্সের পাওনা পরিশোধ করার জন্য। কিন্তু বাসের কন্ডাকটর ভাড়া কাটতে আসলে যাত্রী যেভাবে সেই কন্ডাকটরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে উদাস হয়ে বসে থাকে, মেক্সিকো সরকারও ঠিক সেভাবে ফ্রান্সের তাগাদার বিপরীতে উদাস হয়ে বসে রইলো।
ঠিক এমন সময়ে রাজা ফিলিপের নজরে আসলো বছর দশেক আগে করা পেস্ট্রির দোকানদার রেমোঁতেল এর সেই অভিযোগটা। তিনি এবার মেক্সিকোকে জানালেন, রেমোঁতেলের এই আর্থিক ক্ষতির জন্যে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, না হয় তিনি মেক্সিকো সরকারকে দেখে নিবেন। মেক্সিকো সরকার জানতে চাইলো, কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে? রাজা ফিলিপ কতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে হাতের আঙ্গুলে হিসাব করে জানালেন, দশ বছর পরে সুদে আসলে মিলিয়ে জরিমানা দিতে হবে ছয় লক্ষ পেসো। জবাবে মেক্সিকো জানালো, ফ্রান্সের সব পেস্ট্রির দোকানের পেস্ট্রিগুলো একত্র করলেও তাদের দাম এত হবে না। সুতরাং একটা পেস্ট্রির দোকান ভাংচুর এবং সব পেস্ট্রি খেয়ে ফেলার জন্যে তারা কখনোই এত টাকা জরিমানা দিবেনা।
এর কিছুদিন পর, ১৮৩৮ সালের অক্টোবর মাসে রাজা লুই ফিলিপ রেমোঁতেলের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য ফ্রান্স থেকে মেক্সিকোতে এক বিশাল নৌবহর পাঠিয়ে দিলেন। তারা সেখানে গিয়ে শেষবারের মত তাদের পাওনা অর্থ ফেরত চাইলো। জবাবে মেক্সিকো যথারীতি ‘না’ জানিয়ে দিলো। এর পরপরই সেই নৌবহর মেক্সিকোর ‘সান হুয়ান ডি উলুয়া’ প্রাসাদে গোলাবর্ষণ করা শুরু করলো। একইসাথে তারা মেক্সিকোতে প্রবেশের সব সমুদ্রপথ আটকে দিলো। মেক্সিকোর সমুদ্র বন্দর গুলো অচল হয়ে পড়লো। সেখানে চলমান ‘ভেরা ক্রুজ’ এর যুদ্ধে মেক্সিকোর এক বিশাল নৌবাহিনীর সলিল সমাধি ঘটলো ফরাসী নৌবাহিনীর হাতে।
মেক্সিকো ফ্রান্সের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সাথে না পেরে এবার অন্য পথ ধরলো। তারা মেক্সিকোর এক জেনারেল ‘সান্তা অ্যানা’ -কে তার বহু বছরের অবসর জীবন থেকে বেরিয়ে এসে যোদ্ধাবাহিনী গঠন করে যুদ্ধে নামার ডাক দিলো। এই স্যান্তা আনা সেখানকার জনগণের কাছে সুপারহিরোর মত ছিলেন। তারা হয়ত ভেবেছিলো, তাকে ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’র মত ‘জেনারেল মেক্সিকো’ জাতীয় কিছু একটা বানিয়ে ফ্রান্সকে শিক্ষা দেয়া যাবে। সান্তা অ্যানা এই ডাকে সাড়া দিয়ে তার অবসর জীবন হতে বেরিয়ে এলেন। তার নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী গড়ে উঠলো। তারা একের পর এক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে লাগলো, যাতে মেক্সিকোকে ফ্রান্সের কাছে তাদের দেনা পরিশোধ না করতে হয় !
পেস্ট্রি যুদ্ধের ফলাফল
পেস্ট্রি যুদ্ধ চলেছিলো ১৮৩৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৩৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। এক পর্যায়ে মেক্সিকান বাহিনী আর না পেরে পিছু হটতে লাগলো। তাদের সেই ‘জেনারেল মেক্সিকো’ সান্তা অ্যানা হাঁটুতে গুলি লেগে এক পা হারালেন। অবশেষে ব্রিটিশ সরকারের মধ্যস্থতায় ফ্রান্স এবং মেক্সিকোর এই যুদ্ধের অবসান হলো। মেক্সিকো পেস্ট্রি ব্যবসায়ী রেমোঁতেলকে ফ্রান্সের দাবী অনুযায়ী ছয় লক্ষ পেসো দিতে সম্মত হলো। সেই হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করা যায় রেমোঁতেলকে।
পরবর্তীতে রেমোঁতেল সেইপেস্ট্রি যুদ্ধ অর্থ দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার পেস্ট্রি শপের ব্রাঞ্চ খুলেছিলেন কিনা, তা অবশ্য আর জানা যায়নি। ওই যুদ্ধের ঘটনার এখানেই সমাপ্তি ঘটলো !