একবার এফডিসিতে আড্ডার মাঝখানে একজন উদীয়মান নির্মাতা বলে ফেললেন, “৮০ (লক্ষ) পাইলে আমি নিজেই বাংলাদেশে টাইটানিক ছবি বানাইয়া দেখাইতে পারতাম”। প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা বাজেটের একটি ছবিকে মাত্র ১ কোটিতে নির্মাণ করার সাহস দেখানো ঐ ভদ্রলোককে এরপর আর কোনদিন দেখিনি। তবে তার সাহসী বক্তব্য আজো অনুপ্রেরণা যোগায়। সত্যিই বাংলাদেশি নির্মাতারা শতকোটি বাজেটের সিনেমা এক কোটিতে নির্মাণ করার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মান। কি বিশ্বাস হচ্ছে না ?
আমেরিকা যে Memento মুভি ৭৫ কোটি টাকা খরচ করে বানিয়েছিল, ভারত সেটা ১২ কোটি টাকায় Ghajini নামে বানায়। আর বাংলাদেশ সেটা ১ কোটিরও কম খরচে “ধোঁকা” নামে বানিয়েছিল। এখন হয়ত আমাদের রিমেক করা ছবির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সবার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, Memento ও Ghajini সিনেমার মত আমাদের ধোঁকা সিনেমাটিও ব্যবসাসফল ছিল। সমালোচকদের প্রশংসা কুঁড়িয়ে ২০০৭ সালে দুইটি ক্যাটাগরিতে মেরিল-প্রথম আলো পুরষ্কারও পেয়েছিল। সুতরাং বাংলাদেশি সিনেমাকে ছোট করার কোন অবকাশ নেই (যদিও আমরা সেটা করেই বেশি তৃপ্তি পাই)।
ফ্রম হলিউড টু বাংলাদেশ ভায়া ইন্ডিয়া
যাই হোক, আসুন জেনে নেই আরো দশটি বাংলাদেশি সিনেমা সম্পর্কে, যেগুলো বাংলাদেশ ভারত থেকে এবং ভারত হলিউড থেকে পাচার (সরি) রিমেক করেছিল।
১. দোস্ত দুশমন (১৯৭৭) : জীবন বাজি রেখে এক গ্রামের ডাকাত দলের বিরুদ্ধে দুই বন্ধুর (ওয়াসিম ও সোহেল রানার) সংগ্রামের গল্প নিয়ে দেওয়ান নজরুল ১৯৭৭ সালে নির্মাণ করেন এ্যাকশন এডভেঞ্চার মুভি “দোস্ত দুশমন”। সিনেমাটি রমেশ সিপ্পি পরিচালিত; অমিতাভ বচ্চন ও ধর্মেন্দ্র অভিনীত ১৯৭৫ এর অলটাইম ব্লকবাস্টার হিন্দি সিনেমা Sholay এর অনুকরণে নির্মিত। কথিত আছে, গাব্বার সিংহের চরিত্রে অভিনয় করা আমজাদ খান একই চরিত্রে বাংলাদেশের ভার্সনে অভিনয় করা জসিম সাহেবের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এই Sholay সিনেমাটি কিন্তু আবার একাধিক ভিনদেশি সিনেমার কপি-পেস্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কপি করা হয়েছে জন স্টার্গস পরিচালিত; ইউল ব্রাইনার ও ইলি ভাল্লাক অভিনীত ১৯৬০ এর আমেরিকান মুভি The Magnificent Seven থেকে। যেটা কিনা আবার আকিরা কুরুসাবা পরিচালিত ১৯৫৪ এর এপিক জাপানী মুভি Seven Samurai হতে কপি করা।
২. রাঙা বউ (১৯৯৮) : এক ছিদ্রান্বেষী সাইকো স্বামীর (হুমায়ুন ফরিদীর) কবল থেকে মুক্তি পাওয়া এক নারীর (ঋতুপর্ণার) গল্প নিয়ে মোহাম্মদ হোসেন ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করেন রোমান্টিক থ্রিলার মুভি “রাঙা বউ”। সিনেমাটি তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে “বোল্ড” বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হয়। ছবিটি পার্থ ঘোষ পরিচালিত; নানা পাটেকর ও মনীষা কৈরালা অভিনীত ১৯৯৬ এর হিন্দি সিনেমা Agni Sakshi এর কপি। যা কিনা আবার জোসেফ রুবেন পরিচালিত; প্যাট্রিক বার্গিন ও জুলিয়া রবার্টস অভিনীত ১৯৯১ এর আমেরিকান মুভি Sleeping With The Enemy এর অনুকরণে নির্মিত। উল্লেখ্য যে, Sleeping With The Enemy মুভির থিমে ১৯৯৮ তে বাদল খন্দকারের “সাগরিকা” ছাড়াও সারা বিশ্বে মোট ১৩টি সিনেমা নির্মিত হয়েছে।
৩. অদৃশ্য শত্রু (২০১৪) : পিতৃ-হত্যার প্রতিশোধ নিতে সংকল্পবদ্ধ এক ছদ্মবেশী যুবকের (জায়েদ খানের) গল্প নিয়ে ২০১৪ সালে আকিব পারভেজ ও মাশরুর পারভেজ নির্মাণ করেন ক্রাইম থ্রিলার মুভি “অদৃশ্য শত্রু”। সিনেমাটি আব্বাস মাস্তান পরিচালিত ও শাহরুখ খান অভিনীত ১৯৯৩ এর হিন্দি সিনেমা Baazigar এর আদলে নির্মিত। যা কিনা আবার জেমস ডিয়ার্ডেন পরিচালিত ও ম্যাট ডিলন অভিনীত ১৯৯১ এর ব্রিটিশ-আমেরিকান মুভি A Kiss Before Dying এর আদলে নির্মিত। যা কিনা আবার ইরা মার্ভিন লেভিন রচিত ১৯৫৩ এর একই নামের সাড়াজাগানো উপন্যাস অবলম্বনে রচিত।
৪. শুভ বিবাহ (২০০৯) : ছোটবেলার বন্ধুর (অপু বিশ্বাসের) বিয়ে ভাঙতে আসা এক যুবকের (ফেরদৌসের) কাণ্ডকারখানার গল্প নিয়ে দেবাশীষ বিশ্বাস ২০০৯ সালে নির্মাণ করেন রোমান্টিক কমেডি মুভি “শুভ বিবাহ”। ছবিটি সঞ্জয় গাধভি পরিচালিত; উদয় চোপড়া ও টিউলিপ জোশি অভিনীত ২০০২ এর হিন্দি মুভি Mere Yaar Ki Shaadi Hai এর অনুকরণে নির্মিত। যা কিনা আবার পল জন হোগান পরিচালিত; জুলিয়া রবার্টস ও ডার্মট মালরনি অভিনীত ১৯৯৭ এর আমেরিকান মুভি My Best Friend’s Wedding এর পুরুষ সংস্করণ।
৫. হৃদয় থেকে পাওয়া (২০০৯) : নিজের একমাত্র সন্তানের জীবন বাঁচানোর পুরো সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা এক পিতার (মান্নার) গল্প নিয়ে মোহাম্মদ হোসেন জেমী ২০০৯ সালে নির্মাণ করেন সোশ্যাল ড্রামা মুভি “হৃদয় থেকে পাওয়া”। ছবিটি অনুভব সিনহা পরিচালিত ও সঞ্জয় দত্ত অভিনীত ২০০৬ এর হিন্দি সিনেমা Tathasu এর কপি। যা কিনা আবার নিক ক্যাসাভেটস পরিচালিত ও ডেঞ্জেল ওয়াশিংটন অভিনীত ২০০২ এর আমেরিকান মুভি John Q. এর কপি।
৬. প্রেমে পড়েছি (২০১০) : এক উদীয়মান সঙ্গিত শিল্পীর (শাকিব খানের) দুর্ঘটনাবশত এক ধনীর দুলালীর (রোমানার) জীবনে জড়িয়ে পড়ার নানা ঘটন-অঘটনের গল্প নিয়ে শাহাদাৎ হোসেন লিটন ২০১০ সালে নির্মাণ করেন রোমান্টিক কমেডি মুভি “প্রেমে পড়েছি”। যা রাজ কানোয়ার পরিচালিত; সালমান খান ও রানি মুখার্জী অভিনীত ২০০০ সালের হিন্দি মুভি “Har Dil Jo Pyar Karega” এর কপি। এই হিন্দি ছবিটি প্রিয়দর্শন পরিচালিত ১৯৯৭ সালের মালয়লাম মুভি Chandralekha এর রিমেক। যা আবার জন টার্টেলটাব পরিচালিত; বিল পুলম্যান ও সান্দ্রা বুলোক অভিনীত ১৯৯৫ এর আমেরিকান মুভি While You Were Sleeping এর আদলে নির্মিত।
৭. রিটার্ন টিকেট (২০০৯) : একজন স্বপ্নবাজ তরুণ ট্যাক্সি ড্রাইভার (ইমতিয়াজ)কে জিম্মি করে একজন সিরিয়াল কিলারের (সোহেল রানার) একের পর এক সিরিয়াল কিলিং এর শ্বাসরুদ্ধকর গল্প নিয়ে মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) ২০০৯ সালে নির্মাণ করেন ক্রাইম থ্রিলার মুভি “রিটার্ন টিকেট”। ছবিটি হাসনাইন হায়াদ্রাবাদওয়ালা ও রক্ষা মিস্ত্রী পরিচালিত; ইমরান হাশমি ও ইরফান খান অভিনীত ২০০৬ এর হিন্দি সিনেমা The Killer এর আদলে নির্মিত। এই ছবিটিও কিন্তু মাইকেল মান পরিচালিত; জেমি ফক্স ও টম ক্রুজ অভিনীত ২০০৪ আমেরিকান মুভি Collateral এর কপি।
৮. পাগলা হাওয়া (২০১২) : একজন অপহৃত নারী (একা) ও তার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য এক যুবকের (কাজী মারুফ) শ্বাসরুদ্ধকর অভিযাত্রার গল্প নিয়ে নজরুল ইসলাম খান ২০১২ সালে নির্মাণ করেন এ্যাকশন থ্রিলার মুভি “পাগলা হাওয়া”। ছবিটি বিক্রম ভট্ট পরিচালিত; ঊর্মিলা মাতন্ডকর ও জায়েদ খান অভিনীত ২০০৭ এর হিন্দি সিনেমা Speed এর আদলে নির্মিত। যা কিনা আবার ডেভিড রিচার্ড এলিস পরিচালিত; কিম ব্যাসিঙ্গার ও ক্রিস ইভান্স অভিনীত ২০০৪ এর আমেরিকান মুভি Cellular এর হুবহু কপি।
৯. রংবাজ (২০১৭) : একজন ডাক্তারের (কাজী হায়াতের) কাছ থেকে থেরাপি নেওয়া এক যুবক গ্যাংস্টারের (শাকিব খানের) সেই ডাক্তারেরই মেয়ের (শবনম বুবলির) প্রেমে পাগল হওয়ার গল্প নিয়ে শামিম আহমেদ রনি ও আব্দুল মান্নান ২০১৭ সালে নির্মাণ করেন গ্যাংস্টার কমেডি মুভি “রংবাজ”। ছবিটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ডেভিড ধাওয়ান পরিচালিত; অমিতাভ বচ্চন, ঐশ্বরিয়া রাই ও সঞ্জয় দত্ত অভিনীত ২০০২ এর হিন্দি সিনেমা Hum Kisise Kum Nahin এর অনুকরণে নির্মিত। যা কিনা আবার হ্যারোল্ড র্যামিস পরিচালিত; বিলি ক্রিস্টাল, রবার্ট ডি নিরো ও লিসা কুড্রো অভিনীত ১৯৯৯ আমেরিকান মুভি Analyze This এর আদলে নির্মিত।
১০. জামাই শ্বশুর (২০০৩) : একজন শ্বশুর (রাজীব), তার তথাকথিত জামাই (রিয়াজ) ও তার মনের মানুষের (পূর্ণিমার) মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির হাস্যরসাত্মক গল্প নিয়ে শাহাদাৎ খান ২০০৩ সালে নির্মাণ রোমান্টিক কমেডি মুভি “জামাই শ্বশুর”। ছবিটি ডেভিড ধাওয়ান পরিচালিত; ওম পুরি, গোবিন্দা ও ঊর্মিলা মাতন্ডকর অভিনীত ২০০০ সালের হিন্দি সিনেমা Kunwara এর কপি। যা কিনা আবার জায়ান্থ সি. পারানজী পরিচালিত; পরেশ রাওয়াল, চিরঞ্জীবী ও রাম্বা অভিনীত ১৯৯৮ এর সুপারহিট তেলুগু মুভি Bavagaru Bagunnara এর রিমেক। এই Bavagaru Bagunnara ছবিটি আবার আলফোনসো অরো পরিচালিত; গিনাকার্লো গিয়ান্নিনি, কীনু রীভস ও আইতানা স্যাংকেজ-গিজন অভিনীত ১৯৯৫ এর আমেরিকান মুভি A Walk in the Clouds এর আদলে নির্মিত। যা কিনা আবার আলেস্যান্দ্রো ব্লাসেট্টি পরিচালিত ১৯৪২ এর ইটালিয়ান মুভি Four Steps in the Clouds এর অনুকরণে নির্মিত।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ভারত বা অন্য কোন দেশের সিনেমাকে আঘাত করা নয় । যারা বাংলাদেশের ভারতীয় সিনেমা নকল করাকে ঘৃণিত বা ন্যক্কারজনক কাজ বলে মনে করেন, তাদের আঙ্গুল দিয়ে এটাই দেখিয়ে দিচ্ছি যে আমরা যদি নকলের ছাত্র হই, তাহলে ভারত নকল করার মাস্টার।
নিজের দেশকে ভালোবাসুন, নিজের দেশের সিনেমাকে ভালোবাসুন। ভারতীয় কোন সিনেমা ১০০০ কোটি টাকা ব্যবসা করলেও আপনি বা আপনার দেশ কি পাবে জানি না; তবে আমার দেশের সিনেমার একটা ৪০ টাকা দামেট টিকেট বিক্রি হলেও সরকার ন্যূনতম ৬ টাকা ট্যাক্স পায়। ধন্যবাদ।