সময়টা ১৯৬০ সালের ৩ মে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলার এক ধনাঢ্য পরিবারের কর্তা ছিলেন আব্দুল মালেক। ওইদিন তার স্ত্রী দেলোয়ারা’র কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করে এক ছোট্ট শিশু। বড় ভাই মাসুদ পারভেজ -এর নামের সাথে মিল রেখে নবজাতকের নাম রাখা হলো মাসুম পারভেজ। তখন কে জানতো, এই দুই ভাই এক সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ধরা দিবে !
চিনতে পারলেন না তো? কে এই মাসুদ পারভেজ আর মাসুম পারভেজ ! নামই তো শুনিনি কখনো ! এরা কবে কোন চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ছিলো ! সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে তাদের ছদ্মনাম জানলেই…
হ্যাঁ, দুই ভাই বাংলা চলচ্চিত্র জগত কাঁপিয়েছেন ছদ্মনাম ধারন করে। চলচ্চিত্র জগতে এই দুই ভাই পরিচিত সোহেল রানা এবং রুবেল নামে। এখন নিশ্চয়ই চিনতে কোন সমস্যা হচ্ছে না? না হবারই কথা, বাংলাদেশে হয়ত এমন কোন সিনেমাখোর নেই, যে এই দুই ভায়ের সিনেমা দেখেননি।
আজ ৩ মে, ছোটভাই মাসুম পারভেজ ওরফে নায়ক রুবেল এর জন্মদিন। জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাচ্ছি এই বিশেষ আর্টিকেলের মাধ্যমে।
যেভাবে দ্বিতীয়বার জন্ম নিলেন রুবেল
দর্শকের সামনে রুবেলের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৮২ এবং ১৯৮৩ সালে। এটাকেই মূলত রুবেলের দ্বিতীয়বার জন্ম নেয়াকে বুঝানো হয়। এবার তিনি জন্ম নিয়েছেন নক্ষত্র রুপে ! তাও কোনো টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টারের মত নক্ষত্র নয়, বড়সড় জ্বলজ্বলে নক্ষত্র !
নায়ক কিংবা সিনেমার কোন চরিত্রে নয়, ওই দুই বছর তিনি জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক লাভ করেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করার পর বড় ভাই সোহেল রানা’র পরামর্শে ১৯৮৬ সালে সিনেমা জগতে পা রাখেন রুবেল। সোহেল রানা প্রযোজিত এবং শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত তার প্রথম সিনেমার নাম ছিলো ‘লড়াকু’। নিজের অনন্য শৈলীর মাধ্যমে প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেন রুবেল। কারাতে কিংবা মার্শাল আর্টের সঙ্গে তখনো অপরিচিত বাংলাদেশের দর্শক। সিনেমার পর্দায় রুবেলের মার্শাল আর্টের মাধ্যমে ভিলেনদের নাস্তানাবুদ করার স্টাইল মুহূর্তেই জনপ্রিয় হয়ে যায় দেশের নবীন থেকে শুরু করে প্রবীণ অব্দি সব ধরনের দর্শকের মাঝে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রুবেলকে। একের পর এক হিট ছবি উপহার দিয়ে যান রুবেল। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত রুবেলের প্রত্যেকটা সিনেমা ছিলো সুপারহিট। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে এই অসামান্য এবং অকল্পনীয় রেকর্ড ছিলো শুধু সালমান শাহ্’র। তবে সালমানের সিনেমা সংখ্যা ছিলো খুবই কম। সেই তুলনায় রুবেল-কে এগিয়ে রাখা যায় কারন ওই সময়ে প্রায় ২০০ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি, যার প্রত্যেকটা সিনেমা ছিলো ব্যবসা সফল।
টানা দেড় দশক সিনেমাহল কাঁপানো নায়ক রুবেলের প্রয়োজন ছিলো না কোনো কালো বন্দুক কিংবা পিস্তলের। খালি হাতেই কুংফু’র মাধ্যমে ভিলেনকে বধ করে উদ্ধার করতেন নায়িকাকে। রুবেলকে তুলনা করা হয় হলিউডের ব্রুস-লি’র সাথে। অনেকে আবার তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের ভিন ডিজেল বলেও মনে করেন। রুবেলের প্রত্যেকটা সিনেমায় থাকতো নিত্য নতুন মারামারির কৌশল। কখনো দুই পা শূন্যে তুলে ভেঙে ফেলতেন খেজুর গাছে ঝুলানো মাটির কলসি। কখনো শূন্যে লাফিয়ে একসাথে ৭-৮ জন ভিলেনকে লাথি দিয়ে ধরাশায়ী করতেন। আর দর্শকরা চোখ কপালে তুলে দেখতো, আমাদের নায়কও পারে ব্রুস-লি’র মতো কুংফু, যা তখন বলিউডেও সম্ভব ছিলো না।
১৯৮৬-তে লড়াকু’র মাধ্যমে যে রুবেল অধ্যায়ের শুরু হয় তা এগিয়ে চলে উদ্ধার, বীরপুরুষ এবং বজ্রমুষ্ঠি ছবির মাধ্যমে। প্রথম চারটি ছবির হুলস্থূল সাফল্যের মাধ্যমে তৎকালীন সব প্রযোজক ও পরিচালকদের নজরে চলে আসেন রুবেল। সবাই নিজের ছবিতে নায়ক হিসেবে দেখতে চায় রুবেলকে। রুবেলও ফেরাননি কাউকে। একে একে অভিনয় করেন হুংকার, বীর বিক্রম, আমি শাহানশাহ্, বিষদাঁত, বজ্রপাত, অকর্মা, ইনকিলাব, আজাদ, উত্থান-পতন, সন্ত্রাস, শেষ আঘাত, দেশ দুশমন, অর্জন, লাওয়ারিশ সহ দুইশ’রও বেশি সিনেমায়। রুবেলের প্রত্যেকটা ছবিই ছিলো মারমার কাটকাট ঘরানার।
তার হাঁটা-চলা, কথা বলা, চুলের স্টাইল, পোশাক আষাক হয়ে উঠে তৎকালীন যুব সমাজের জন্যে অবশ্য-অনুকরণীয়। তখনকার অনেকেই রুবেলকে অনুকরণ করে চুলে বাটি কাটিং দিতেন। দেশীয় ফ্যাশনে কেডসের জন্মই এই রুবেলই দিয়েছিলেন ! তাকে অনুসরণ করে একসময় মানুষ পাজামা লুঙ্গি ফতুয়ার সাথেও কেডস পরা শুরু করে।
১৯৯১-এ যখন নাইম-শাবনাজ জুটি, কাঞ্চন-দিতি জুটি, মান্না-চম্পা জুটি তুঙ্গে তখনও রুবেল একের পর এক ছবির মাধ্যমে একাই সবাইকে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় মুক্তি পায় গোলাবারুদ, বীরযোদ্ধা, সম্পর্ক, অপহরন, ঘরের শত্রু, শত্রু ঘায়েল, রক্ত নিশান, সতর্ক শয়তান, মীরজাফর, গোয়েন্দা, জ্বলন্ত বারুদ, শত্রু ভয়ংকর ছবিগুলো। এরপর সালমান কিংবা সানির যুগেও রুবেল ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল এবং নিজের ধারার সিনেমার একক অধিপতি। কেউই রুবেলের সিনেমা থেকে দর্শক ফেরাতে পারেনি।
রুবেল শুধু একজন অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন ফাইট ডিরেক্টরও। তার প্রায় প্রত্যেকটা ছবিতেই তার নিজস্ব ফাইট গ্রুপ ‘দ্য এ্যকশন ওয়ারিয়র্স’ কাজ করেছে। সেই সময় দেশে মার্শাল আর্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠে রুবেলের কল্যানে। দলে দলে কিশোর তরুনরা যোগ দিতে থাকে মার্শাল আর্ট শেখার স্কুলে। রুবেল তার বিভিন্ন সিনেমায় মার্শাল আর্টের ভিন্ন ভিন্ন কলাকৌশল উপস্থাপন করেন। সেগুলোর মধ্যে ব্লাইন্ড কংফু, ড্যান্সিং কুংফু, ড্রাংঙ্কিং কুংফু এবং উইপিং কুংফু উল্লেখযোগ্য।
প্রায় ৫০ এরও বেশি অভিনেত্রী’র সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন রুবেল। নব্বই দশকের একেবারে শেষ দিকে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসেন রুবেল। নিজস্ব প্রযোজনায় তার প্রথম ছবি ছিলো ‘বাঘের থাবা’। ছবিটি ব্যাবসা সফল হয়। রুবেল এরপর হাত দেন ছবি পরিচালনার কাজে। পরিচালক হিসেবে তার প্রথম ছবি ‘বিচ্ছু বাহিনী’ মুক্তি পায় ২০০১ সালে। ছবিটি তৎকালীন সময়ে রেকর্ড ব্রেকিং ব্যাবসা করার পাশাপাশি একটি বিভাগে জাতীয় পুরষ্কার অর্জন করে। নায়ক হিসেবে ওই ছবির জন্যে তিনি বাচসাস পুরষ্কার পান। এখন পর্যন্ত তিনি ১৭-টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। এছাড়াও ১৯৯৮ সালে তিনি লাক্স আনন্দধারা পুরষ্কার এবং ২০০০ সালে ‘যোদ্ধা’ ছবির জন্যে বাচসাস পুরষ্কার পান। চলচ্চিত্রে সমগ্র অবদানের জন্যে ২০১৭ সালে তিনি শিল্পী সমিতির পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা পুরষ্কার পান। রুবেল অসংখ্যবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হলেও কখনো বিজয়ী হতে পারেননি।
ব্যক্তিগত জীবনে নায়ক রুবেল
রুবেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন।
নায়ক রুবেল শুরু থেকেই ব্যক্তিগত জীবনকে মিডিয়ার আলোচনায় আসতে দেননি। ১৯৮৫ সালে তিনি সুলতানা পারভেজ নীলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং এক বছর পরেই তার একমাত্র ছেলে নিলয় পারভেজ জন্মগ্রহণ করেন।
নায়ক রুবেলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় হচ্ছে তিনি বাংলাদেশ কারাতে ফাউন্ডেশনের পরিচালক।
বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক রুবেল চিরদিন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হয়ে থাকবেন এবং ইতিহাসে সর্বকালের সেরাদের তালিকায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।