আমাদের ব্যাক্তি, অর্থনীতিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটা কাজের মধ্যে বা ভুল হলে বা কিছু জিনি লুকোতে আমরা সত্য বলা বাদ দিয়ে মিথ্যের আশ্রয় নেই। আসলে মিথ্যা জিনিসটা কি, সত্যের সাথে এর পার্থক্যটা কই এবং কে বলেছে মিথ্যা বলা মহাপাপ চলুন জেনে নেই।
সত্যের বিপরীত হচ্ছে মিথ্যা। সত্য সুন্দর, মিথ্যা কুৎসিত। প্রকৃতপক্ষে মিথ্যার অসারতা মানবতাকে কলুষিত ও কলঙ্কিত করে। মিথ্যে কথা, মিথ্যাচার কোনোভাবেই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। বরং তা অকল্যাণের পঙ্কিলতায় মানুষকে ডুবিয়ে দেয়। সত্য হচ্ছে আলো আর মিথ্যে অন্ধকার, আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়ালা তালসিসুল হাক্কা বিল বাতিলি ওয়া তাকতুমুল হাক্কা ওয়া আন্তুম তা’লামুন- তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না। (সূরা বাকারা : আয়াত ৪২)।
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সত্য আর মিথ্যা এক হতে পারে না। সত্যকে লুকায়ে রেখে মিথ্যার প্রশ্রয়ে যাওয়া মানবতা বিরুদ্ধ কাজ। সত্য ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রিয় হলেও সত্য তার সুরভী ছটায়, অকাট্য রূপে বহমান থাকে। সত্যকে যারা প্রত্যাখ্যান করে তারা মানুষের কলঙ্ক। হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে যে, মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি, আর তা হচ্ছে যখন সে কথা বলে তা মিথ্যা বলে, ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং আমানতের খিয়ানত করে।
হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমরা অবশ্যই সত্যকে অবলম্বন করবে, কেননা সত্য সৎকর্মের দিকে ধাবিত করে আর সৎ কর্ম ধাবিত করে জান্নাতের দিকে। কোনো ব্যক্তি যদি সদা সত্য কথা বলে এবং সত্যের প্রতিই সদা মনোযোগ রাখে তা হলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছেও সিদ্দীক (সত্যবাদী) হিসেবে তার কথা লিপিবদ্ধ হয়। তোমরা নিজেকে মিথ্যা থেকে রক্ষা করবে, কেননা মিথ্যা অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়, আর অন্যায় নিয়ে যায় জাহান্নামের দিকে। কোনো বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে এবং মিথ্যার প্রতিই সে মনোনিবেশ করে, তাহলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছেও কাযযাব (অতি মিথ্যুক) বলে তার নাম লিপিবদ্ধ হয়। (তিরমিযী শরীফ)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, সত্য হচ্ছে পবিত্রতা এবং পবিত্রতাই জান্নাতের পথ দেখায় আর মিথ্যা হচ্ছে অপবিত্রতা এবং অপবিত্রতাই জাহান্নামের পথ দেখায়। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)।
মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যাচার করা জঘন্য অপরাধ। মিথ্যা কখনও সুফল বয়ে আনে না। মিথ্যার পরিণাম হচ্ছে ধ্বংস। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মিথ্যার বেসাতির কারণে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, অনেক সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : সুতরাং পৃথিবী পরিভ্রমণ করে দেখো, যারা সত্যকে মিথ্যা বলেছে তাদের পরিণাম কী হয়েছে? (সূরা নাহল : আয়াত ৩৬)।
মিথ্যা ঈমানকে ধ্বংস করে দেয় আত্মবিশ্বাস ও আত্ম অনুভূতিকে নির্মূল করে দেয় এবং মানবিক মূল্যবোধকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে। একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম খুতবা প্রদানকালে বললেন : হে মানুষ! মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার সমপর্যায়ের হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। এরপর হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তিলাওয়াত করলেন : ফাজতানিবুর রিজসা মিনাল আওছানি ওয়াজতানিবু কাওলাযুর- সুতরাং তোমরা বর্জন করো অপবিত্রতা এবং দূরে থাকো মিথ্যা বলা থেকে। (তিরমিযী শরীফ)।
এখানে লক্ষণীয় যে, মিথ্যা কথা বলাকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম শিরক গুনাহর পর্যায়ভুক্ত গুনাহ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অন্য একখানি হাদীসে আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন : আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় মহাপাপ সম্পর্কে জানাবো? সাহাবায়ে কিরাম বললেন : হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল! তিনি তখন বললেন : আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতামাতার নাফরমানি করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কিংবা মিথ্যা কথা বলা। (তিরমিযী শরীফ) সঙ্গে শরীক করা, পিতামাতার নাফরমানি করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কিংবা মিথ্যা কথা বলা। (তিরমিযী শরীফ)।
মূলত মিথ্যাই হচ্ছে সকল পাপ কাজের উৎস। হাদীস শরীফে আছে যে, আল কিযবু ইউহলিকব- মিথ্যা ধ্বংস আনয়নকারী। কুরআন মজীদে মিথ্যাচারী সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : অভিশপ্ত হোক মিথ্যাচারীরা। (সূরা যারিয়াত : আয়াত ১০)।
মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যাচার করার মধ্য দিয়ে অতি সাময়িক ফায়দা লাভ হলেও কিংবা আত্মতৃপ্তি এলেও মূলত তা দীর্ঘকালীন ফায়দা থেকে বঞ্চিত করে। মিথ্যা কখনও ধোপে টেকে না। কোনো না কোনোভাবে তা ফাঁস হয়ে মিথ্যাবাদীর জন্য বয়ে আনে মারাত্মক দুর্ভোগ। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়াইলুল্লিকুল্লি আফফাকি, আছিম- দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী পাপীর (সূরা জাছিয়া : আয়াত ৭)। হযরত রসূলুল্লাহ, সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : কঠিন দুর্ভোগ তার জন্য যে মিথ্যা ও অলীক কথা বলে লোককে হাসায়। তার জন্য কঠিন দুর্ভোগ, তার জন্য কঠিন দুর্ভোগ। (তিরমিযী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, মুসনাদে আহমদ, দারেমী)।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই ফেরেশতা বলতে রহমতের ফেরেশতা বোঝানো হয়েছে। কারও ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করাও বড় মহাপাপ, কবীরা গুনাহ। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে আর কোনো ব্যক্তি নিজের কোনো দোষযুক্ত বা পাপের কাজ করার পর সে কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ওপর তা আরোপ করলেও সে মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা নিজেই বহন করে। (সূরা নিসা : আয়াত ১২), যারা সাধ্বী রমণীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না তাদের আশিটা কশাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। আর ওরাই ফাসিক। (সূরা নূর; আয়াত ২৩)।
মিথ্যা শপথ করতে ইসলাম কঠোর নিষেধ করেছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা একে অপরের প্রবঞ্চিত করবার জন্য শপথকে ব্যবহার করো না। যদি করো তাহলে তোমাদের কদম স্থির হবার পর পিছলিয়ে যাবে। (সূরা নাহল : আয়াত ৯৪)।
কিয়ামতের লক্ষণাদি সম্পর্কে হাদীস শরীফে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত একখানি হাদীসে আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : প্রায় ত্রিশজন মিথ্যাবাদী ও প্রতারকের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত হবে না। এরা প্রত্যেকে নিজেকে আল্লাহর বার্তাবাহক হিসাবে দাবি করবে। (তিরমিযী শরীফ)।
অন্য হাদীসে আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : অচিরেই আমার উম্মতের মধ্য থেকে ত্রিশজন অতি মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে। তারা প্রত্যেকেই দাবি করবে যে, সে নবী অথচ আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোনো নবী নেই (তিরমিযী শরীফ)। কিছু কপট, প্রতারক ও ভ-ের উল্লেখ করে হাদীস শরীফে আছে, যাদের কথাবার্তা হবে নবীদের মতো, তাদের কাজকর্ম হবে ফেরাউনের মতো আর তাদের অন্তর হবে হিংস্র সিংহের মতো, অন্য বর্ণনায় তাদের অন্তর হবে শয়তানের অন্তরের মতো। এই সমস্ত ভ-, প্রতারক, মিথ্যাবাদীদের খপ্পর থেকে মূল্যবান ঈমান ও আকিদা রক্ষা করার জোর তাকীদ রয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : হে মু’মিনগণ! তোমাদের দায়িত্ব তোমাদেরই ওপর। তোমরা যদি সৎ পথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না (সূরা মায়িদা : আয়াত ১০৫)।
অন্য এক হাদীসে আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যার অন্তর পবিত্র এবং রসনা সত্যবাদী সে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসের যে দিনে দশ হাজার সাহাবায়ে কেরাম নিয়ে বিজয়ী বেশে মক্কা মুকাররমায় প্রবেশ করেন সেদিন তিনি কুরআন মজীদের যে আয়াতে কারীমা বারবার উচ্চারণ করছিলেন তা হচ্ছে : সত্য এসেছে এবং মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবার। (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৮১)। সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে মিথ্যাই পরাভূত হয়। কোনো বিবেকবান মানুষ মিথ্যাবাদী হতে পারে না। মিথ্যাচারী ও মিথ্যাবাদীদের শেষ পরিণতি ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর হয়।
অবশেষে বলা সকল হাদিসের প্রেক্ষিতে বলা যায়, মিথ্যা বলা মহাপাপ ! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যাচার করা দুটোই পাপ কাজ, যার দ্বারা মানুষ গুনাহগার এর পরিনত হয়।