‘বাকরখানি’ উৎপত্তির পেছনে রয়েছে রক্তাক্ত এক ইতিহাস !

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক যত খাবার আছে তার মধ্যে বাকরখানিকে অবশ্যই বিশেষ একটা জায়গা দখল করে আছে। পুরান ঢাকায় আসলে আপনাকে প্রাতরাশে এক কাপ চায়ের সাথে দুটো বাকরখানি খেতেই হবে। মজার ব্যাপার হলো, বাকরখানি বয়সের হিসেবে খুবই নতুন। মাত্র ২৫০ বছর আগে সূদুর আফগানিস্তান থেকে এসেছে এই খাবারটা। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই বাকরখানীর আদ্যোপান্ত !

বাকরখানি

ময়দা দিয়ে তৈরি রুটি জাতীয় এক খাবার বিশেষ হচ্ছে এই বাকরখানি। এটি পুরান ঢাকার সকালের নাস্তা হিসাবে একটি অতি প্রিয় খাবার। ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়। ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের বাকরখানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকায়। বাকরখানি তে সাধারণত ময়দার সাথে স্বাদবর্ধক আর কিছু দেয়া হয় না। তবে চিনি দেয়া বাকরখানিও একেবারে বিরল নয়।চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাকরখানি রসালো ও সুমিষ্ট। ঢাকার একসময়ের প্রসিদ্ধ রুটির মধ্যে অন্যতম ছিল এই বাকরখানি। বাকরখানি এতই প্রসিদ্ধ ছিল যে এটি উপঢৌকন হিসেবে প্রেরিত হত। এখনো পুরনো ঢাকার কোনো কোনো অঞ্চলে তৈরি হয় বাকরখানি। সেখানে তা ‘শুখা’ (শুকনো) নামেও পরিচিত। বাকরখানির উৎপত্তি স্থান হল আফগানিস্তানে। আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এর প্রচলন এখনো বিদ্যমান।ঢাকায় সর্বপ্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠে লালবাগ কেল্লার কাছে।

বাকরখানির ইতিহাস

বাংলাদেশে বাকরখানির প্রচলন নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন অভিমত। বাকরখানি রুটির নামের পেছনে আছে এক করুণ ইতিহাস। জনশ্রুতি অনুসারে, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নামানুসারে এই রুটির নামকরণ করা হয়েছে।

নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের পরষ্পরের প্রেমে পড়েন। কিন্ত উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিল পথের কাঁটা, সে খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করে এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান ও তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে হারিয়ে দেন। অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। উজির ছেলের হত্যার বিচার চায়। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ পুত্র বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। ইতিমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে গেছে ও সে জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে গেছে দক্ষিণ বঙ্গে। উদ্ধার করতে যান বাকের খনি বেগমকে। পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। ছেলে জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেস্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। এই অবস্থাতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে। বাকেরগজ্ঞে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ত্যাগ করে রয়ে গেলেন প্রিয়তমার সমাধির কাছে, দক্ষিণ বঙ্গে। বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালি-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি রুটির নামের পেছনেও রয়েছে বাকের-খনির প্রেমের ইতিহাস।

অবশ্য নামকরণের ব্যাপারে অন্য আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। সে অনুযায়ী, মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটি প্রচলন করেন। তিনি বৃহত্তর বরিশালের জায়গীরদার ছিলেন। তার প্রেয়সী ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে আগা বাকের ২য় মুর্শিদ কুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি ভুলে যান নি। তার আবিস্কৃত এবং প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি রুটির নাম তার প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি রুটি। পরবর্তীতে এই নাম কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে বাকরখানি নাম ধারণ করে। জনশ্রুতি মেনে নিলে ধরে নিতে হয়, বাখরখানির সৃষ্টি আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। অনেকে আবার ধারণা করেন, সিলেট জেলায় সর্বপ্রথম বাকরখানি তৈরী হয়।

বাংলাদেশে বাকরখানী প্রধানত তিন ধরনের –

  1. ঢাকার বাকরখানি : নোনতা, মচমচে
  2. চট্টগ্রামের বাকরখানি : রসালো, মিষ্টি
  3. সিলেটের বাকরখানি : মচমচে, ঝাল

শুনে অবাক হবেন, এই বাকরখানি আমাদের সাথে এতটাই মিশে গেছে যে প্রাচীনবাংলার ছড়া সাহিত্যে এর প্রভাব সুস্পষ্ট। পাঠকের সুবিধার্থে এরূপ একটি ছড়া উল্লেখ করা হলো –

“আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি
বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা
হাতের কলম জনম দুঃখী তাকে বেচো না…”

পরিশেষে বলা যায় যে, বাকরখানিকে নিয়ে যত ইতিহাস থাকুক না কেনো সেটা নিয়ে আসলেই কি মাথা ব্যথার দরকার আছে? দিনশেষে এক কাপ চায়ের সাথে আপনার বাকরখানি লাগবেই।

Leave a Reply