ইলুমিনাতি : বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে গোপন যে সংস্থাটি

ইলুমিনাতি – শব্দটার সাথেই যেন জড়িয়ে আছে রহস্যের গন্ধ। বিগত প্রায় দুই শতক যাবৎ পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া সব বড় বড় যুদ্ধ কিংবা রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের পেছনে অনেকেই দায়ী করে থাকেন এই সংগঠনটিকে। সত্যিই কি তাই? আসলেই কি এতোটা শক্তিধর সংগঠন এই ইলুমিনাতি? কিংবা কারা এর সদস্য? কি এদের কাজ? এরা কি চায়? এমন হাজারো প্রশ্ন যুগ যুগ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে রহস্য সন্ধানী জনতার মাথায়। চলুন, খানিকটা সময় নিয়ে ঘুরে আসি ইলুমিনাতির রহস্যময় জগত থেকে।

ইলুমিনাতি এর ইতিহাস

সতেরো শ’ শতকের কথা, ইউরোপে তখন ক্যাথলিকদের রাজত্ব চলছে। ক্যাথলিজমের বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে কিংবা তাদের মতবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই রয়েছে নির্মম শাস্তির বিধান। ক্যাথলিজমের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গোপন সংস্থা গড়ে উঠলেও তাদের নেই তেমন কোনো অগ্রগতি। ১৭৭৬ সালে এগিয়ে এলেন জার্মানির ব্যাভারিয়া রাজ্যের একজন পেশাদার শিক্ষক, নাম তার অ্যাডাম ওয়েইশপ্ট। অ্যাডাম ওয়েইশপ্ট তখন ইঙ্গলস্তাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্যাথলিক আইন’ বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন।

পহেলা মে, ১৭৭৬ -এই দিন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ওয়েইশপ্টের ইলুমিনাতি। শুরুতে তাদের সদস্য সংখ্যা ছিলো ৫ জন। ওয়েইশপ্ট নিজে এবং সাথে তার ৪ ছাত্র।

আক্ষরিক অনুবাদে ইলুমিনাতি (illuminati) শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, ‘এক দল লোক, যারা কোনো একটা বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী।’ আর ইলুমিনাতির সদস্যদের ভাষ্যমতে তারা কুসংস্কার মুক্ত (মূলত ধর্মীয় কুসংস্কার) এক নতুন পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই করছে।

ইলুমিনাতি

যেভাবে সদস্য বাছাই করে ইলুমিনাতি

প্রাথমিক পর্যায়ে ওয়েইশপ্ট নিজে যাচাই বাছাই করে ইলুমিনাতি’র সদস্য নির্বাচন করতেন। ধীরে ধীরে তাদের ব্যাপ্তি বিস্তৃত হবার সাথে সাথে এই প্রক্রিয়াও অন্যান্য সিনিয়র সদস্যদের হাতে চলে যায়। বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে যে, তাদের টার্গেটে থাকতো শিক্ষিত এবং সচ্চরিত্রবান ক্যাথলিকরা। নারী, ইহুদি আর ধর্মগুরুরা নিষিদ্ধ ছিলো এই সংঘে। তরুন-যুবকদের প্রাধান্য ছিলো সবচেয়ে বেশি। প্রথমদিকে খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করে সদস্য বাছাই করা হত, যেনো ঘুণাক্ষরেও বাইরের কেউ তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে না পারে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ করে তারা মেম্বার রিক্রুট করতো। কিন্তু এতো সাবধানতার পরেও জানাজানি হয়ে যায় ইলুমিনাতির অস্তিত্ব। ব্যাভারিয়ার শাসক চার্লস থিওডোর ১৭৮৫ সালের ২ মার্চ ইলুমিনাতি -কে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন এবং এর সদস্যদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। পালিয়ে গেলেন অ্যাডাম ওয়েইশপ্ট। বন্ধ হয়ে গেলো ইলুমিনাতি।

কিন্তু না, ১৭৯৮ সালে জন রবিনসন নামক একজন লেখকের ‘Proofs of a Conspiracy’ নামক বইতে দাবী করা হয় যে আঠারোশ’ শতকের শেষ ভাগের ফরাসী বিপ্লবের কলকাঠি নেড়েছে ইলুমিনাতি এবং এই সংগঠন এখনো অব্দি তাদের কাজ করে যাচ্ছে নিরবে। পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি বইয়ে ইলুমিনাতি সক্রিয় থাকার দাবী করা হয়। জনমনে আবারো জেগে উঠে ইলুমিনাতি আশঙ্কা। এরপর থেকে আজ অব্দি আর কখনোই এদের কোনো সদস্য কিংবা লিডারদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।

ইলুমিনাতি’র বর্তমান

বর্তমান সময়ে ইলুমিনাতির অস্তিত্ব এবং কার্যক্রম সম্পর্কে অনেক রসালো ধারনা করা হয়ে থাকে। যেমন আমেরিকা সম্পূর্ণরূপে ইলুমিনাতির দখলে চলে গেছে। এর প্রমান হিসেবে দেখানো হয় আমেরিকান ডলারের উপর লিখা MDCCLXXVI, যা একটি রোমান সংখ্যা। এর অর্থ ১৭৭৬, অর্থাৎ ইলুমিনাতির জন্মসাল। কিন্তু ১৭৭৬ আসলে আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের বছর। আবার আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন. এফ. কেনেডি’র হত্যার পিছনেও ইলুমিনাতি’র হাত রয়েছে বলে ধারনা করা হয়।

বিভিন্ন ভিভিআইপি এবং মিডিয়া সেলিব্রেটিকে ইলুমিনাতির সদস্য বলে সন্দেহ করা হয়। যেমন বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, জর্জ বুশ সিনিয়র, জর্জ ডাব্লিউ বুশ, রিহান্না, বিয়ন্সে, লেডি গাগা, মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা, এমনকি হালের জাস্টিন বিবারও রয়েছে সন্দেহের তালিকায়।

ইলুমিনাতি – নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার

ইলুমিনাতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রজেক্ট হিসেবে ধারনা করা হয় ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’। এই ছক অনুযায়ী সমগ্র বিশ্ব থাকবে ইলুমিনাতি’র ছত্রছায়ায় এবং পৃথিবীতে জীবিত সকল মানুষ হবে ইলুমিনাতিতে বিশ্বাসী। আরো ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে, পৃথিবীর ৭৫০ বিলিয়ন মানুষ কমিয়ে মাত্র ২ বিলিয়ন অর্থাৎ ২০০ কোটিতে নামিয়ে আনা হবে। এরপর তাদের নিয়ে শুরু করা হবে এক নতুন পৃথিবী যার পুরোটাই শাসন করবে ইলুমিনাতি। এটা করার একমাত্র পথ হচ্ছে বিশাল কোনো গণহত্যা। এই থেকে ধরে নেয়া হয় যে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পিছনেও আসল কলকব্জা নেড়েছে ইলুমিনাতি।

এরকম অসংখ্য সূত্র ধরে, অর্থাৎ দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে পৃথিবীর তাবৎ বড় বড় ঘটনার সাথে ইলুমিনাতির সম্পৃক্ততা ব্যাখ্যা করা হলেও এর কোনো সঠিক প্রমান আজ অব্দি কেউ দিতে পারেনি।

বর্তমানে বেশ কিছু সংগঠন সর্বসমক্ষে নিজেদের ইলুমিনাতি পরিচয় দেয় কিন্তু ব্যাপারটা যথেষ্টই সন্দেহজনক। যেখানে ব্যাভারিয়ান ইলুমিনাতি’র প্রধান লক্ষ্যই ছিলো নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে নিরবে কাজ করে যাওয়া।

মূলত ড্যান ব্রাউনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমন্স’ নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে এই ইলুমিনাতি তত্ত্ব।

শত বছর যাবৎ আলোচনা সমালোচনা এবং বিভিন্ন জল্পনা কল্পনার আশ্রম এই ইলুমিনাতি। যেহেতু সমগ্র ব্যাপারটাতেই রয়েছে একটা নিষিদ্ধ গোপনীয়তার রস, সেহেতু বিষয়টা জনমনে ব্যাপকভাবেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে। এমনটা তো হতেই পারে যে আমাদের চিন্তা-চেতনা ছাড়া আর কোথাও অস্তিত্ব নেই এই রহস্যঘন ইলুমিনাতির, তাই না?

আরো পড়ুনঃ

Leave a Reply