এইযে আমরা প্রতিদিন যে ভাষায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে চলেছি, কখনো ভেবেছেন আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে কেমন ছিলো এই ‘বাংলা ভাষা’? কিভাবে জন্ম হলো এই ভাষার? কিভাবেই বা হাজার বছর ধরে বেড়ে উঠেছে আমাদের প্রাণের ভাষা? অথবা ভেবে দেখুন তো, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ফেসবুক আবিষ্কার হলে কেমন হতো সেকেলে মানুষের স্ট্যাটাস ! এসকল প্রশ্নের উত্তরগুলো খুুঁজতেই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস…
যতদূর জানা যায়, বাংলা ভাষা হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবংশের সদস্য । যার উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে! খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এই ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবংশ থেকে জন্ম নেয় ‘শতম’। এর প্রায় এক হাজার বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে ‘শতম’ ভাষাটি রুপান্তরিত হয় ‘আর্য’ ভাষায় । তবে তখন পর্যন্তও উপমহাদেশে আর্য ভাষার চল হয়ে ওঠেনি । ভারত উপমহাদেশে আর্য ভাষার চল শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দে আর্য জাতি আগমনের পর ।
উপমহাদেশে আর্য ভাষা চালু হবার পরবর্তী তিনশো বছরে পরিবর্তনের উপমহাদেশীয় হাওয়া লাগে আর্য ভাষায় । প্রচুর পরিমাণ সংস্কৃত ভাষার শব্দ যোগ হয়ে আর্য ভাষা রুপ নেয় ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্য’ ভাষায় (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ) । আর্য জাতির পাশাপাশি ধীরে ধীরে উপমহাদেশর সাধারণ মানুষও আপন করে নেয় এই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা । তখন আরো কিছুটা রুপান্তরিত হয়ে এ ভাষা হয়ে ওঠে ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য’ ভাষায় (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ) যা ‘আদিম প্রাকৃত’ নামেও পরিচিত । এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ হতে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আদিম প্রাকৃতের রুপান্তর ঘটে প্রথমে ‘প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত’ এবং পরবর্তীতে ‘গৌড়ি প্রাকৃত’ ভাষা দুটির উৎপত্তি হয় । আর এই গৌড়ি প্রাকৃত থেকে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে জন্ম হয় ‘গৌড়ি অপভ্রংশ’ ভাষার।
এই গৌড়ি অপভ্রংশ থেকেই ৯০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উৎপত্তি হয় ‘বাংলা’ ভাষার । শুরুর দিকে অবশ্য বাংলা ভাষা ঠিক শতভাগ এমন ছিল না । ভাষাবিদগণের ভাষায় সে সময়ের বাংলা কে বলা হয় ‘প্রাচীন বাংলা’ । এরপর ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আসে ‘মধ্য বাংলা’ এবং ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সেটা রুপ নেয় ‘আধুনিক বাংলা’ ভাষায় । অর্থাৎ, যে ভাষায় আমরা এখন কথা বলি ।
এ তো গেল বাংলা ভাষার জন্মকথা । কিন্তু পরিবর্তনের ধারায় হাজার বছর ধরে কেমন ছিল ভাষাটি ? নিচের উদাহরণেই তার উত্তর পাবেন ।
ইন্দো ইউরোপিয়ান – য়ূস এক্ব্যোম্ স্পেক্যিএথে
শতম – য়ূস এশ্বোম্ স্পেশিএথে ।
আর্য – য়ূস অশ্বম্ স্পশ্যাথ্ ।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য – য়ূয়ম অশ্বম্ স্পশ্যাথ্ ।
আদিম প্রাকৃত – তুষ্মে ঘোটকং দৃক্ষথ্ ।
প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত – তুমহে ঘোটকং দেক্খথ্ ।
গৌড়ি প্রাকৃত – তুমহে ঘোড়াঅং দেক্খহ ।
গৌড় অপভ্রংশ – তুমহে ঘোড়অ দেক্খহ।।
প্রাচীন বাংলা – তুমহে ঘোড়া দেখহ ।
মধ্য বাংলা – তুমহি ঘোড়া দেখহ ।
আধুনিক বাংলা – তুমি ঘোড়া দেখ ।
এই আধুনিক বাংলা ভাষার জন্যেই ১৯৫২ সালের আজকের এই দিনে প্রাণ দিয়েছিলেন বাংলার সূর্য-সন্তান রফিক, বরকত, আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বারেরা । যা আপনাদের সবারই জানা । তবে অনেকেই যেটা জানেন না তা হলো, বাংলা ভাষার জন্য শুধু বাংলাদেশিরা নয় আন্দোলন করেছেন দেশের বাইরের অনেক মানুষই । পঞ্চাশ এর দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের (এরাও বাঙালি) মানভূম জেলায়ও হয় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন । ১৯৬১ সালে আমাদের দেশে হয়ে যাওয়া ভাষা আন্দোলনের জেড় ধরে ভারতের শিলচরে বাংলা ভাষার আন্দোলনে ১১ জন শহীদও হন ।
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৭ মে ইউনেস্কো আমাদের ভাষা এবং ভাষা শহীদদের সম্মানে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেয় । শুধু তাই নয় আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওন নামের দেশটিও সম্প্রতি বাংলা কে তাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে । পুরো পৃথিবীজুড়ে প্রায় বিশ কোটির বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে । ভাষাভাষী লোকসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সপ্তম এবং একই সাথে তিনটি দেশের রাষ্ট্রভাষা ‘‘আমাদের প্রাণের বাংলা’’ !