সারি সারি ঘরবাড়ি। কোথাও দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরনো ভাঙা দালান। কোথাও ধ্বংসস্তুপ। যতদূর দেখা যায় শুধুই নির্জনতা চেপে ধরে রয়েছে। কেমন একটা গা ছমছম ভাব চারদিকে। অতলস্পর্শী পাতকুয়ো, মন্দির, পাথুরে পথ, সবই আছে। নেই শুধু থাকার মত কেউ !
প্রায় ২০০ বছর যাবৎ এভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে রাজস্থানের কুলধারা গ্রাম, ভারতের রাজস্থানের জয়শলমীর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে‚ এ গ্রামটি ভৌতিক। তার নাকি আবার জলজ্যান্ত প্রমাণও মিলেছে ! নীরব মরুভূমির কোলে এই গ্রামের জন্ম হয়েছিলো ১২৯১ সালে। যোধপুরের পালি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা এখানে তাদের আবাস গড়েছিলেন। কৃষি এবং ব্যবসায় দুটোতেই সমান দক্ষ ছিলেন তাঁরা। এই মরুভূমিতেও তাঁরা গমের ফলন করতে পারতেন ! কুলধারার সাথে তখন আশেপাশের আরো ৮৩টি গ্রামে গড়ে ওঠে বসতি। উন্নতির শীর্ষে থাকলেও ১৮২৫ সালে রাখীপূর্ণিমার রাতে ফাঁকা হয়ে যায় কুলধারা এবং তার লাগোয়া ৮৩টি গ্রাম। রাতারাতি পুরোপুরি ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যান প্রায় ১,৫০০ মানুষ !
কি করে হলো? তার পিছনেও আছে বিরাট কাহিনী…
প্রচলিত আছে‚ স্থানীয় সামন্ত শাসক সালিম সিং নাকি কুলধারা গ্রামের প্রধানের কন্যার প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলন। হুমকি দিয়েছিলেন‚ বিয়ে না দিলে গ্রামবাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে প্রচুর কর। কিন্তু সেই শর্তে রাজি হননি কুলধারা গ্রামের প্রধান। তাঁর সাথে সাথে গোটা গ্রামও শপথ নেয়, কিছুতেই তাঁরা তাঁদের গ্রামের মেয়ের সাথে সামন্ত শাসকের বিয়ে দিবেনা। এই সামন্ত শাসকের কুনজর থেকে বাঁচতেই রাখীপূর্ণিমার রাতে কুলধারা এবং তার লাগোয়া সব গ্রামের মানুষ উধাও হয়ে যান !
কিন্তু এক রাতেই উধাও হয়ে কোথায় যান তারা? তারা কি অন্য কোথাও বসত গড়েছিলেন? কিছুই আর জানা যায়নি। সেই রাতে একেবারেই গায়েব হয়ে যান তারা। ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে কর্পূরের মত মিলিয়ে যায় এতগুলো মানুষ !
প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা জনপদ কুলধারা রাতারাতি হয়ে পড়ে ভৌতিক। এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুলধারা। দিল্লির প্যারানরমাল সোসাইটি থেকে ৩০ জনের একটি দল রাত কাটাতে গিয়েছিলো কুলধারা গ্রামে। তাদের দাবী‚ পুরো রাত জুড়েই নাকি অদ্ভুত আর অলৌকিক সব ঘটনা ঘটেছে ধ্বংসস্তূপে ভরা এই গ্রামে। আচমকা রাতের বুক চিরে শোনা যায় আর্তচিৎকার। হঠাৎ হঠাৎ করেই দারুণভাবে কমে যায় তাপমাত্রা। সকালে নাকি গাড়ির গায়ে দেখা যায় শিশুদের হাতের ছাপ ! অথচ এর ধারেকাছে কোনো মানববসতিই নেই। পুরো ফাঁকা একটি বিরাট এলাকা ! কোথেকে এলো এ হাতের ছাপ?
কুলধারা গ্রামের মানুষ যেখানেই যাক না কেন‚ তাদের আত্মা পড়ে আছে এখানেই। পরিত্যক্ত জনপদের অলিতে গলিতে‚ জনশূন্য বাড়ির উঠোনে-রসুইঘরে‚ মন্দিরের অলিন্দে ভেসে বেড়ায় তাঁদের আশা-আকাঙ্খা। নির্জন এই মরুভূমি যেনো আজো অপেক্ষা করে আছে জনপদের ফিরে আসার জন্যে। অন্তত স্থানীয়রা সেই বিশ্বাসই মনেপ্রাণে লালন করছেন যুগ যুগ ধরে…
কয়েক বছর আগে এই গ্রামটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করে সরকার। সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নেয় ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বর্তমানে একে ব্যাপক প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছে রাজস্থান সরকার। আড়াই শতাব্দী ধরে শূন্যতা বয়ে নিয়ে চলা গ্রামটি এবার হয়ত কিছুটা প্রাণ ফির পাবে পর্যটকদের পদচারণায়। এমনটাই আশা করে স্থানীয়রা। দেখা যাক, ভাগ্য কতটা তাদের সহায় হয়…