জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য ও বিশ্ব সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান আমাদের অজানা। পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারক ও বাহক এবং তাদের অনুসারীগণ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মুসলিম মনীষীদের মুসলমানদের স্মৃতিপট থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য ইসলামের ইতিহাস ও মুসলিম মনিষীদের নাম বিকৃতভাবে লিপিবদ্ধ করেছে। ফলে সঠিক ইতিহাস জানতে না পেরে অনেকে মনে করেন সভ্যতার উন্নয়নে মুসলমানদের তেমন কোনো অবদান নেই বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মুসলিমরা অমুসলিমদের নিকট ঋণী। কিন্তু এই ধারনা ভুল !
এমন এক যুগ ছিল যখন আল্লাহ তায়ালার করুণায় মুসলিমদের মধ্যে ধন্য মানুষের জন্ম হয়েছিলো। তাঁরা জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল ধারা বা শাখা প্রশাখা আবিষ্কার করে গেছেন। তাঁদের মৌলিক আবিষ্কারের উপরই বর্তমান জ্ঞান বিজ্ঞান এর অধিষ্ঠান।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যেসকল মুসলিম মনীষীদের অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে ইবনুন নাফিস অন্যতম। পুরো নাম আলাউদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবুল হাজম ইবনুন নাফিস আল কোরায়েশী আল মিসরী।
তিনি ৬০৭হিজরী মোতাবেক ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান দামেস্ক, মিসর নাকি সিরিয়াতে, এ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। তবে তাঁর নামের শেষে মিসরী সংযুক্ত থাকায় তিনি মিসরে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে অনেকে মনে করেন।
ইবনুন নাফিস তাঁর প্রথম জীবন অতিবাহিত করেন দামেস্কে এবং মহাজজির উদ্দীন আদ খাওয়ারের নিকট তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এত বুৎপত্তি লাভ করেন যে তৎকালীন সময়ে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। তথ্য অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
খলিল আসসাকিদি তাঁর ওয়াদি বিল ওয়াকায়াত গ্রন্থে লিখেছেন, “ইবনুন নাফিস ছিলেন অতি বিশিষ্ট দক্ষ ইমাম এবং অতি উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞ হাকিম।”
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর অবদান সর্বাধিক। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য লাভের পর তিনি কায়রো গমন করেন এবং সেখানকার মাসরুবিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকাহ (আইন) শাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
ইবনুন নাফিস মানবদেহে রক্তসঞ্চালন পদ্ধতি, ফুসফুসের সঠিক গঠন পদ্ধতি, শ্বাসনালী, হৃত্পিণ্ড, শরীর শিরা উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারকে অবহিত করেন।
ইবনুন নাফিস মানবদেহে রক্তচলাচল সম্পর্কিত গ্যালেনের মতবাদের ভুল ধরিয়ে এবং এ সম্বন্ধে নিজের মতবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অমর হয়ে আছেন। তিনি তাঁর ইবনে সিনার কানুনের এনাটমি অংশের ভাষ্য ‘শরহে তসরিহে ইবনে সিনা’ গ্রন্থে এ মতবাদ প্রকাশ করেন।
তিনি ৫ জায়গায় হৃত্পিণ্ড এবং ফুসফুসের ভিতর দিয়ে রক্ত চলাচল সম্বন্ধে ইবনে সিনার মত উদ্ধৃত করেছেন এবং ইবনে সিনার এ মতবাদ যে গ্যালেনের মতবাদেরই পুনরাবৃত্তি তাও দেখিয়ে দিয়ে এ মতবাদের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, শিরার রক্ত এর দৃশ্যমান বা অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে ডানদিক থেকে বামদিকের হৃৎপ্রকোষ্ঠে চলাচল করে না; বরং শিরার রক্ত সব সময়েই ধমনী শিরার ভিতর দিয়ে ফুসফুসে যেয়ে পৌঁছায়। সেখানে বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে শিরার ধমনীর মধ্য দিয়ে বামদিকের হৃৎপ্রকোষ্ঠে যায় এবং সেখানে জীনবতেজ গঠন করে।
তিনি ফুসফুস এবং হৃত্পিণ্ডের এনাটমি নিয়ে আলোচনা করেন। ইবনে সিনা এ্যারিস্টটলের মতবাদের সাথে একমত করে হৃত্পিণ্ডে তিনটে প্রকোষ্ঠ রয়েছে বলে যে মত প্রকাশ করেছেন তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। এ্যারিস্টটল মনে করতেন যে, দেহের পরিমাপ অনুসারেই হৃৎপ্রকোষ্ঠ সংখ্যার কম বেশী হয়। ইবনুন নাফিস এ্যারিস্টটলের এই মতকে ভুল বলে প্রমাণ করেন।
ইবনুন নাফিসের মতে হৃত্পিণ্ডে মাত্র দু’টো হৃৎপ্রকোষ্ঠ আছে। একটা থাকে রক্তে পরিপূর্ণ এবং এটা থাকে ডানদিকে আর অন্যটিতে থাকে জীবনতেজ, এটা রয়েছে বামদিকে। এই দুইয়ের মধ্যে চলাচলের কোনো পথই নেই। যদি থাকত, তাহলে রক্ত জীবনতেজের যায়গায় বয়ে গিয়ে সেটাকে নষ্ট করে ফেলত। হৃত্পিণ্ডের এনাটমি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইবনুন নাফিস যুক্তি দেখান যে, ডানদিকের হৃৎপ্রকোষ্ঠে কোন কার্যকরী চলন নেই এবং হৃত্পিণ্ডকে মাংসপেশীই বলা হউক বা অন্যকিছুই বলা হউক তাতে কিছু আসে যায়না। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ মতবাদটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞান সম্মত বলে গৃহীত হলেও ইবনুন নাফিস কে বিজ্ঞান জগতে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
ইবনুন নাফিস অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বহু বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ২০খণ্ডে ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানন’ এর ভাষ্য প্রণয়ন করেন। এতে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন কঠিন সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন রোগের ঔষধ সম্পর্কে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘কিতাবুশ শামিল ফিল সিনায়াত তিব্বিয়া’। গ্রন্থটি প্রায় ৩০০ খণ্ডে সমাপ্ত হবার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে তা সম্ভব হয়নি। এ গ্রন্থটির হস্তলিপি দামেস্কে রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনি হিপোক্রেটস, গ্যালেন, হুনায়েন, ইবনে ইসহাক এবং ইবনে সিনার গ্রন্থের ভাষা প্রণয়ন করেন।
তিনি হাদীসশাস্ত্রের উপরও কয়েকখানা ভাষ্য লেখেন। এছাড়া তিনি আরও বহু গ্রন্থ রচনা করেন। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘আল্ মুখতার মিনাল আগজিয়া (মানবদেহে খাদ্যের সম্বন্ধে)’, ‘আল কিতাবুল মুহাজ ফিল কুহল (চক্ষু রোগ সম্বন্ধে)’, ‘শারহে মাসায়েলে ফিত, তিব্ব’, ‘তারিকুল ফাসাহ’, ‘মুখতাসারুল মানতেক’ প্রভৃতি।
ইবনুন নাফিস ৬৮৭ হিজরী মোতাবেক ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে সুস্থ করে তোলার প্রায় সকল চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়ে যায়। অবশেষে মৃত্যুশয্যায় তাঁর মিসর ও কায়রোর চিকিৎসক বন্ধুরা তাঁর রোগের প্রতিষেধক হিসেবে তাঁকে মদ পান করতে অনুরোধ করেন। মদ পান করলেই তাঁর রোগ সেরে যাবে বলে তাঁরা পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি একফোঁটা মদ পান করতেও রাজি হলেন না। তিনি বন্ধুদেরকে উত্তর দিলেন, “আমি আল্লাহ পাকের দরবারে চলে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি চিরদিন এ নশ্বর পৃথিবীতে থাকতে আসিনি। আল্লাহ আমাকে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন আমি চেষ্টা করেছি মানুষের কল্যাণে কিছু করে যেতে। বিদায়ের এ লগ্নে শরীরে মদ নিয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে উপস্থিত হতে আমি চাই না।”
অতঃপর ৬৮৭ হিজরীর ২১শে জিলকদ মোতাবেক ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ডিসেম্বর রোজ শুক্রবার সকালে এ মহামনীষী ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি তাঁর একমাত্র বাড়ীটি ও তাঁর সমস্ত বইপত্র মনসুর হাসপাতালে দান করে যান।