বাইসাইকেল (Bicycle) বা সাইকেল একটি জনপ্রিয় বাহন। পা দিয়ে চালিত এই যানটি পরিবেশ দূষণ করে না। বর্তমানে বিভিন্ন রকম সাইকেল ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবহনের পাশাপাশি সাইকেলনির্ভর কিছু খেলা এবং সার্কাসও রয়েছে। এছাড়া অনেকে শারীরিক ব্যায়ামের অংশ হিসাবেও সাইকেল চালায়। তবে মানুষ জন্মগতভাবে দুই চাকার উপর ভারসাম্য রাখতে পারেনা বলে সাইকেল চালানো শিখতে হয়।
দুই চাকার বাইসাইকেল
বাইসাইকেলের গোল চাকা দুটি কাঠামো সাধারণত ধাতব পাত দিয়ে তৈরি করা হয়। চাকার কেন্দ্রের সাথে পাত অনেকগুলো স্পোক (Spoke) দিয়ে সংযুক্ত থাকে। এই স্পোকগুলো পাতের গোল আকৃতি বজায় রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া একাধিক স্পোক থাকার প্রধান কারন হলো, উঁচু-নিচু জায়গায় চলার সময় যেন পাতের কোন বিশেষ অংশে বেশি পরিমাণ চাপ পড়ে চাকা বেঁকে না যায়। চাকার উপর ব্রেক থাকে, যার সাহায্যে চলন্ত সাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বাইসাইকেলের কাঠামো
কাঠামো বাইসাইকেলের প্রধান অংশ। অধিকাংশ সাইকেলের কাঠামো ধাতব পাত দিয়ে তৈরি। পাতগুলোতে বিভিন্ন রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়, যেন মরিচা না পড়ে। শিশুদের সাইকেলের কাঠামো সাধারণত কিছুটা ভারী ও শক্ত হয়, আবার রেসিং প্রতিযোগীতার সাইকেলগুলো হয় শক্ত কিন্তু হালকা, যেন বাতাসের বাধা কম অতিক্রম করতে হয়। কাঠামোর মাঝখানে থাকে আসন। অনেক সাইকেলেই এ আসনটি উপরে উঠানো বা নিচে নামানো যায়। আসনের পেছনেই থাকে ছোট পণ্যবাহী জায়গা বা ক্যারিয়ার (Carrier)। পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি অনেক সময় এখানে মানুষও বহন করা হয়।
ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ
বাইসাইকেলের হাতল থাকে। এটি দিক ঠিক রাখা ও পরিবর্তনে সাহায্য করে। পুরো সাইকেলের ভারসাম্যও এটির সাহায্যেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ব্রেকের শুরুটা হাতল থেকেই হয়ে থাকে। এ কারণে প্রয়োজনের সময় চালক সহজেই ব্রেকে চাপ দিয়ে সাইকেলের গতি পরিবর্তন করতে পারে।
যেভাবে চলে বাইসাইকেল
পেডাল ও চেইনের সাহায্যে আধুনিক সাইকেল চালানো হয়। পেডাল ও পেছনের চাকার কেন্দ্রে গিয়ার থাকে। এই গিয়ার আবার স্প্রোকেট নামেও পরিচিত। ফলে পেডাল ও পেছনের চাকার মধ্যে সংযোগ সাধিত হয়। পেডাল ঘোরালে পেছনের চাকাটি সামনের দিকে বল প্রয়োগ করে। ফলে সামনের চাকাও ঘুরতে শুরু করে এবং সাইকেল সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অর্থাৎ পেছনের চাকাই সাইকেলের মূল চালক। এ কারণে জোরে পেডাল ঘোরানো অবস্থায় হঠাৎ করে সামনের চাকায় ব্রেক চাপলে সাইকেল দুর্ঘটনা হতে পারে।
সাইকেলের চাকা
শুরুর দিকে সাইকেলের চাকা ছিল লোহার পাত দিয়ে তৈরি। উঁচু-নিচু জায়গায় সাইকেল চালালে কয়েকদিনের মধ্যেই চাকাগুলো বেঁকে যেত। গরুর গাড়ি বাঁকা চাকা দিয়ে চালানো সম্ভব হলেও বাঁকা চাকার সাইকেলে ভারসাম্য রাখা সম্ভব নয়। ১৮৮৭ সালে স্কটিশ প্রকৌশলী জন বয়েড ডানলপ (John Boyd Dunlop) রবারের চাকা উদ্ভাবন করেন। রবারের চাকা বাতাস-ভর্তি করে ফুলিয়ে ব্যবহার করা হয়। রবারের চাকা উদ্ভাবনের পর বাইসাইকেল খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়।
গিয়ার সাইকেল
প্রতিযোগিতা জন্য তৈরি করা সাইকেলগুলোতে একাধিক গিয়ার থাকে। এগুলো গিয়ার সাইকেল নামে পরিচিত। এর সাহায্যে অল্প শক্তিতে পেডাল ঘুরিয়েই সাইকেলকে অনেক বেশি গতিতে চালানো যায়। কোনো কোনো সাইকেলে ২৭ টি পর্যন্ত গিয়ার থাকে। গিয়ার সাইকেলগুলোতে বেল বা ঘণ্টির পাশেই আরেকটি ছোট চাকতি থাকে। এটির সাহায্যে গিয়ার পরিবর্তন করা হয়।
পাহাড়ি সাইকেল
কম পরিশ্রমে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য যেমন গিয়ার সাইকেল ব্যবহার করা হয়, তেমনি পাহাড়ে ওঠার জন্য বিশেষ ধরনের সাইকেল আছে। তবে রেসিং সাইকেল এবং পাহাড়ি সাইকেলের গঠনে কিছুটা পার্থক্য আছে। শক্তি হলো গতিও টর্ক-এর গুণফল। যখন দ্রুত চলতে হয়, তখন শক্তির প্রায় পুরো অংশটাই গতিতে চলে যায়। পাহাড়ে ওঠার সময় গতির পরিমাণ কমে যায় তখন শক্তির বড় অংশ টর্কে বা উপরে ওঠার জন্য ব্যয় হয়। পাহাড়ের জন্য ব্যবহৃত সাইকেল তুলনামূলকভাবে ছোট, কিন্তু অনেক বেশি শক্ত মজবুত হয়। এতে ঝাঁকুনি প্রতিরোধক (Shock Absorber) ব্যবস্থা থাকে এটি স্প্রিং দিয়ে তৈরি, যা অমসৃণ জায়গায় চলার কাজটা সহজ করে দেয়।
ইতিহাসের পাতায়
বাইসাইকেল বহু মানুষের সম্মিলিত উদ্ভাবন। প্রথম বাইসাইকেল তৈরি করেন জার্মান প্রকৌশলী ব্যারন কার্ল ফন ড্রেইজ (Baron Karl von Drais)। তার নির্মিত সাইকেলটি ছিল কাঠের। পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে এটি চালাতে হতো। পেডালচালিত সাইকেল প্রথম উদ্ভাবন করেন ফ্রান্সের পিয়ের মিশু (Pierre Michaux) এবং পিয়ের লামেন্ট (Pierre Lallement)। তবে সেখানে পেডাল সামনের চাকার সাথে লাগানো ছিল। পেছনের চাকাচালিত বাইসাইকেল প্রথম উদ্ভাবন করেন স্কটিশ প্রকৌশলী টমাস ম্যাককল (Thomas McCall)।
অসাধারণ যানবাহন
পরিবেশগত দিক থেকে বাইসাইকেল খুব কার্যকর একটি বাহন। এটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। চালক পেডালে যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করেন, তার ৯৫ ভাগ শক্তিই চাকায় স্থানান্তরিত হয়, অর্থাৎ ক্ষয় খুব সামান্য। তবে গিয়ার ব্যবহার করলে ক্ষয়ের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যায়। এছাড়া নিয়মিত সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
বাইসাইকেল চালানো মাত্র একবারই শিখতে হয় !
সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা শেখার সময় আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের সেরেবেলাম অংশের স্নায়ুকোষগুলোর এক্সন ও ডেনড্রাইট-এর মধ্যে নতুন কিছু সংযোগ তৈরি হয়। এই সংযোগগুলো সারাজীবন থেকে যায়। ফলে পরবর্তীকালে সাইকেল চালানোর সময় শরীরের কোন অংশ কতটুকু বাঁকিয়ে ভারসাম্য রাখতে হবে, সেটা মস্তিষ্ক আগে থেকেই বুঝে যায়। তবে কোনো দুর্ঘটনায় যদি সেরেবেলামের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে এই সংযোগগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তখন ওই ব্যক্তিকে নতুন করে সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা শিখতে হয়।
বাইসাইকেল সম্পর্কিত মজার তথ্য
- চীনে সাইকেলের সংখ্যা ১০০ কোটির ও বেশি। অথচ ১৮ শতকের পরে সেখানে সাইকেল আনা হয়েছিল !
- প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি সাইকেল তৈরি হয় বিশ্বে!
- ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে জায়গা করে নিয়েছিল বিএমএক্স সাইকেল!
- এক চাকায় সাইকেল চালানোর পদ্ধতিকে হুইলি বলা হয়ে থাকে!
- স্বশক্তিচালিত যানবাহনের মধ্যে সাইক্লিং হচ্ছে সবচেয়ে কর্মশক্তিসাশ্রয়ী বাহন!
- নেদারল্যান্ডসের প্রতি আটজনের মধ্যে সাতজনই সাইকেলের মালিক। আর এদের অধিকাংশের বয়স ১৫ বছরের বেশি!
- তিন চাকার সাইকেলকে বলে ট্রাইক!
- দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের এক ভবনের একটি বাতির ঝাড়ের পুরোটা বানানো হয়েছে সাইকেলের কাঠামো দিয়ে!
- সাইকেল নিয়ে ইংরেজিতে সবচেয়ে বিখ্যাত গানটির নাম ডেইজি বেল। এ গানের শেষ লাইন, এ বাইসাইকেল বিল্ট ফর টু!
- গাড়ি চালানোর চেয়ে সাইকেল চালাতে মানুষের শারীরিক ও স্নায়বিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বেশি প্রয়োজন হয়!
- ফ্রান্সের বিখ্যাত এক সাইকেল রেসে হলুদ রঙের বিশেষ এক জার্সি পড়েন দলনেতা। এ জার্সিকে বলে মেইলল্ট জুন!
- দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে ২০১৩ সালের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ৩৬তম কেপ আর্গাস পিক অ্যান্ড পে সাইকেল টুর!
- সাইকেলের দুই চাকা মাটির ওপরে শূন্যে উড়ে চলার বিশেষ পদ্ধতিকে বলে বানি হপ!
- বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন সাইকেল চালাতে পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, “জীবন হচ্ছে সাইকেল চালানোর মতো। এতে ভারসাম্য রাখতে চাইলে সামনে এগিয়ে যেতেই হবে।”
- চীনে ছোট-বড় সবার সাধারণ বাহন সাইকেল। তাই একসময় চীনকে বলা হতো সাইকেলের দেশ!
- এক্সিডেন্ট হলে আরোহীর যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য সাইকেলের পেছনে এয়ারব্যাগ বসেছে!
- প্রতি পূর্নিমায় দক্ষিণ আফ্রিকার সাইক্লিষ্টরা কেপটাউনের রাস্তায় দল বেঁধে সাইকেল চালায়। এ অনুষ্ঠানের নাম মুনলাইট মাস!
- এক চাকাওয়ালা এবং লম্বা গলাওয়ালা সাইকেলের নাম জিরাফ ইউনিসাইকেল।
- বিশেষ ধরনের বাইসাইকেল রিকামবেন্ট বাইক। ২০০ মিটারে এর রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩৩.২৮৮ কিলোমিটার!
- কিছু ইতিহাসের বইয়ে দেখা যায়, ঘোড়ার গাড়িনির্মাতা ফরাসি দুই পিতা-পুত্র পিয়ের ও আর্নস্ট মাইকক্স প্রথম সাইকেল আবিষ্কার করেন ১৮৬০ সালে।
- ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সাইক্লিস্ট একত্রে জড়ো হওয়ার রেকর্ড গড়েছে তাইওয়ান। সেদিন ৭২,৯১৯ জন সাইক্লিস্ট একত্র হয়েছিল!
- হেনজ স্টুক গত ৫০ বছরে শুধু বাইসাইকেল চেপে পাড়ি দিয়েছেন ছয় লাখ কিলোমিটার। বিশ্বে এটিই সর্বোচ্চ রেকর্ড!
- দামি কিছু সাইকেলে টাইটেনিয়াম ধাতু ব্যবহার করা হয়। মানুষের কোমরের কৃত্রিম জয়েন্টেও এ ধাতু ব্যবহার করা হয়!