হ্যাক এবং হ্যাকার, ইন্টারনেট ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এবং সমালোচিত দুটি শব্দ। ‘হ্যাকার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো, যে ব্যক্তি অনৈতিকভাবে কোনো নেটওয়ার্ট বা কম্পিউটারে অনুপ্রবেশ করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। এই হ্যাকারদের আবার এথিক্যাল ইস্যু এর ওপর ভিত্তি করে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা : হোয়াইট হ্যাট বা এথিক্যাল হ্যাকার, ব্ল্যাক হ্যাট বা নন-এথিক্যাল হ্যাকার এবং গ্রে হ্যাট হ্যাকার অর্থাৎ যাদের এথিক্স অস্পষ্ট। এমন অসংখ্য হ্যাকারদের মধ্যে আবার এমন কিছু হ্যাকার রয়েছেন, যারা ইন্টারনেট ইতিহাসের ‘হ্যাকিং’ অধ্যায়টি বারবার নতুন আঙ্গিকে লিখেছেন। পাল্টে দিয়েছেন হ্যাকিংয়ের চিরাচরিত ধ্যান-ধারণা, কাঁপিয়ে দিয়েছেন গোটা ইন্টারনেট। আজকের লেখায় এদের মধ্য থেকেই ইতিহাসের সেরা পাঁচ হ্যাকার এবং তাদের হ্যাকিং বৃত্তান্ত তুলে ধরা হবে। লেটস স্টার্ট…
সর্বকালের সেরা কয়েকজন হ্যাকার
৫. অ্যাদ্রিয়ান লামো – দ্য হোমলেস হ্যাকার : অ্যাদ্রিয়ান একজন কলম্বিয়ান-আমেরিক্যান গ্রে হ্যাট হ্যাকার। একবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে তৎকালীন নাম্বার ওয়ান সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহু (Yahoo.com) হ্যাক করার মাধ্যমে প্রথম আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর একে একে গুগল, মাইক্রোসফট, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এর মতো বৃহৎ ওয়েবসাইটও হ্যাক করেন তিনি। এছাড়াও উইকিলিকস এবং ওয়ার্ল্ড ডটকমের নিরাপত্তা ত্রুটি প্রকাশ করেও বেশ সমালোচনার সৃষ্টি করেন লামো। এসকল হ্যাকিংয়ের জন্য তার প্রিয় জায়গাগুলো ছিল লাইব্রেরী এবং ক্যাফে, যার জন্য তাকে ‘দ্য হোমলেস হ্যাকার’ বলে অভিহিত করা হয়।
তবে ২০০৩ সালের শেষের দিকে এসে লামোর জীবনে আসে এক টার্নিং পয়েন্ট। ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ প্রবাদের মত হঠাৎ করেই লামোর মতো দুর্ধর্ষ হ্যাকারের মাথায় আসে আত্মসমর্পণের চিন্তা। ৯ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া শহরে যুক্তরাষ্ট্র মার্শালের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মোট ৩টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৬৫,০০০ ডলার জরিমানা এবং দুবছর সাজা খাঁটার পর মুক্তি পান তিনি। বর্তমানে অ্যাদ্রিয়ান একজন কম্পিউটার নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করছেন।
৪. লুলজসেক – দ্য লোল সিকিউরিটি : লুলজসেক বা লুলজ সিকিউরিটি হলো একটি অজ্ঞাতনামা এবং অলাভজনক ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার গ্রুপ, যাদের কাছে হ্যাকিং নিতান্তই এক মজার খোড়াক। এই গ্রুপের মোট সদস্য ৭ জন। লুলজসেক সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে এই দশকের শুরুর দিকে ‘সনি পিকচার্স’ এর ওয়েবসাইট হ্যাকিং এর মাধ্যমে। এরপর খুবই অল্প সময়ের মধ্যে একে একে তারা এফবিআই, সিআইএ, নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, নিউজ কর্পোরেশন সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট হ্যাক করে ফেলে। এরই মধ্যে ঘটে যায় এক মজার ঘটনা। নিউজ কর্পোরেশনের ওয়েবসাইট হ্যাক করে সেখানে তারা প্রচার করে দেয় এটিরই চেয়ারম্যান রুপার্ট মুর্ডোক এর ভূয়া মৃত্যুসংবাদ, জাস্ট ফর ফান !
তবে ২০১১ সালের ২৫ শে জুন হঠাৎই অন্তঃকোন্দলের জের ধরে ভেঙে যায় লুলজসেক। লুলজসেক ভেঙে যাওয়ার ঘোষণা দেবার জন্যও তারা আশ্রয় নেয় আরেকটি হ্যাকিং এর। ‘দ্য টাইমস’ এবং ‘দ্য সান’ এর মতো বিখ্যাত পত্রিকা দুটির ওয়েবসাইট হ্যাক করে সেখানে তারা প্রচার করে লুলজসেক ভেঙে যাবার খবর। পরবর্তীতে ২০১২ সালে লুলজসেক এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের একজন হেক্টর বিশ্বাসঘাতকতা করে লুলজসেক এর বেশ কিছু গোপন তথ্য তুলে দেন আইন প্রয়োককারী সংস্থার কাছে। যার ফলে লুলজসেক এর ৪ জন সদস্য গ্রেফতার হন। হ্যাকিং জগতের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠা হ্যাকিং গ্রুপের কফিনের শেষ পেরেকটিও ঠুকে দেয়া হয় তারই সাথে।
৩. অ্যানোনিমাস – দ্য ডিজিটাল রবিনহুড : হ্যাকিং জগতের সর্বাধিক পরিচিত, সমালোচিত এবং সমাদৃত নাম ‘অ্যানোনিমাস’। এটি একটি অজ্ঞাতনামা হোয়াইট হ্যাট বা এথিক্যাল হ্যাকিং গ্রুপ। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হ্যাকিং গ্রুপটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৮ সালে প্রজেক্ট চ্যানোলজির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তারা এফবিআই, সিআইএ, ভ্যাটিকান, পেপাল, মাস্টারকার্ড, ভিসা এবং বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটে হানা দেয়। এছাড়াও তাদের এথিক্স বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইসরাইল, তিউনিসিয়া, উগান্ডা সহ বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইটেও সাইবার হামলা করে অ্যানোনিমাস। অ্যানোনিমাসের সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, গোটা বিশ্বব্যাপী তাদের সদস্য (অ্যানোনস) রয়েছে এবং সেই সংখ্যা কমপক্ষে ডজনখানেক, এথিক্যালি স্ট্রং হবার দরুণ যারা ডিজিটাল রবিন হুড নামে পরিচিত।
এপর্যন্ত বিভিন্ন দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের বেশ কিছু সদস্য ধরাও পরেছেন, যার মধ্যে লুলজসেক এর তপিয়ারি (যিনি বেশ কিছু প্রজেক্টে অ্যানোনিমাসের সাথে যুক্ত ছিলেন) অন্যতম। তবে অ্যানোনিমাস সংগঠনটি সবচেয়ে বড় ধাক্কার মুখোমুখি হয় ২০১১ সালে ক্রিস ডুয়ন বা কমান্ডার এক্স (চিফ অফ অ্যানোনিমাস) এর গ্রেফতারের পর। ২০১২ সালে অবশ্য ডুয়ন জামিনে মুক্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমান। এছাড়াও পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে অ্যানোনিমাসের মুখপাত্র ব্যারেট ব্রাউন, অ্যানোন-অপস এডমিন ক্রিস্টোফারসহ অনেকেই গ্রেফতার হন। এতসব প্রতিবন্ধকতা পার করেও অ্যানোনসরা এগিয়ে চলেছে তাদের নিজস্ব গতিতে। ২০১২ সালে ‘দ্য টাইমস’ এর বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছিল অ্যানোনিমাস।
২. গ্যারি ম্যাককিননোন – দ্য সলো ওয়ারিয়র : জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে যাবার গল্প হয়তো অনেকেই শুনেছেন। তবে জ্ঞানার্জনের জন্য হ্যাকিং ? তাও আবার নাসার ওয়েবসাইট ! ব্যাপারটা অনেকের কাছেই অকল্পনীয়। তবে এই অকল্পনীয় কাজকেই ২০০১ সালে বাস্তবে রুপ দিয়েছিলেন এই ইংরেজ ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার। ‘UFO’ বা আননোন ফ্লায়িং অবজেক্ট সম্পর্কে কৌতুহল থেকে এ নিয়ে প্রচুর ঘাঁটাঘাটির পরও যখন গ্যারির জ্ঞানপিপাসা মিটছিল না, ঠিক তখনই তিনি নাসার ওয়েবসাইট হ্যাক করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তার কোনো পার্সোনাল কম্পিউটার ছিল না তবুও থেমে থাকেননি গ্যারি। গার্লফ্রেন্ড এর চাচীর বাসার গিয়ে তার কম্পিউটার থেকেই নাসার ওয়েবসাইট হ্যাক করে বসেন তিনি।
তবে সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। নিজের হ্যাকিং স্কিলে নিজেই অভিভূত হয়ে এবার নজর দেন ইউএস মিলিটারির দিকে। বাংলা প্রবাদে অনেকে পড়ে থাকবেন ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’। তবে গ্যারির অভিধানে এই প্রবাদটি বোধ হয় ‘গ্যারি যেদিকে চায়, সাগরেও যেন আগুন জ্বলে যায়’। গ্যারি করে ফেলেন সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হ্যাক ! ইউএস মিলিটারির ওয়েবসাইট হ্যাক করে একটানা ২৪ ঘন্টার জন্য শাট ডাউন করে দেন ২০০০ কম্পিউটার। এতেও যেন মন ভরছিল না তার, ওয়েবসাইটে ‘Your Security is Crap’ লিখে একটি নোটিশ ও ঝুলিয়ে দেন তিনি… স্যাভেজ! ইউএস নেভীর ওয়েবসাইট হ্যাক করে তাদের ৩০০ কম্পিউটারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মত কীর্তিও করে দেখিয়েছেয়েন তিনি। এসকল কুকীর্তির ফলস্বরুপ ২০০২ সালের মার্চ মাসে গ্রেফতার হন গ্যারি। বেশ কিছুকাল সাজা ভোগের পর মুক্তি পান তিনি। তারপর আর হ্যাকিং এর সাথে সম্পৃক্ত হননি তিনি। ২০০৯ সালে বিখ্যাত মিউজিক ব্যান্ড ‘পিংক ফ্লয়েড’ এর সাথে ‘শিকাগো’ শিরোনামে একটি জনসচেতনতামূলক গানও গান গ্যারি। বর্তমানে তিনি স্কটিশ সরকারের সাইবার নিরাপত্তা পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
১. কেভিন মিটনিক – দ্য ফাদার অফ অল হ্যাকার : বাংলা মুভির রাজা মাস্তানের মত কেভিনের অপরাধের (হ্যাকিং) হাতেখড়িও হয় কিশোর বয়সে। মাত্র ১২ বছরে তিনি স্থানীয় বাস সার্ভিসে ফ্রি রাইড করার উদ্দেশ্যে বাসের পাঞ্চ কার্ড হ্যাক করার মাধ্যমে হ্যাকিং জগতে পা রাখেন এই আমেরিকান ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের আরপানেট নেটওয়ার্ক টি হ্যাক করে প্রথম আলোচনায় আসেন কেভিন। এরপরই তিনি হ্যাকিংয়ে ধারাবাহিক হন। বয়স ২০ পার হতেই তিনি তৎকালীন সেরা দুই মোবাইল নির্মাতা কোম্পানি মটোরলা এবং নোকিয়া হ্যাক করার মাধ্যমে তোলপাড় শুরু করে দেন গোটা প্রযুক্তিবিশ্বে।
এছাড়াও বেশকিছু বড় বড় ওয়েবসাইট হ্যাক করেন তিনি। যার মধ্যে পেন্টাগন, ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট সিস্টেম, এফবিআই এবং ফুজিৎসুর ওয়েবসাইট হ্যাকিং অন্যতম। এর মধ্যে ডিইসি এর ওয়েবসাইট হ্যাকিং এর জন্য তাকে এক বছর জেল খাটতে হয়। যদিও তখন তার বিরুদ্ধে হ্যাকিং নয়, অভিযোগটি ছিল চুরির। এ ঘটনার কয়েকবছর পর আরেকটি হ্যাকিং মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় আত্মগোপন করেন কেভিন। প্রায় আড়াই বছর পলাতক থাকার পর ১৯৯৫ সালে ৩২ বছর বয়সে পুলিশের কাছে ধরা পরেন কেভিন। কেভিনকে যখন পুলিশ আটক করে তখন তিনিই ছিলেন পৃথিবীর মোস্ট ওয়ান্টেড হ্যাকার। শতাধিক হ্যাকিংয়ের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তবে মাত্র গুটিকয়েক অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাজাস্বরুপ মাত্র পাঁচ বছরের কারাভোগ শেষে ২০০০ সালে মুক্তি পান তিনি। কিন্তু মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী ৩ বছর যেকোনো ধরনের ইন্টারনেটযুক্ত ডিভাইস ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ভোগ করতে হয় কেভিনকে। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। কেভিনের হ্যাকিং জীবন এতটাই চাঞ্চল্যকর এবং ঘটনাবহুল যে তার জীবনীর ওপর ভিত্তি করে হলিউডে ‘টেকডাউন’ ও ‘ফ্রিডম ডাউনটাউন’ নামে দুটি সিনেমাও তৈরী হয়েছে। হ্যাকিংয়ে অসামান্য দক্ষতা থাকায় তাকে ‘গ্লেন কেজ’ উপাধি দেয়া হয়। ডাকা হয়, ‘ফাদার অফ অল হ্যাকার’ নামে।