১৯১৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে এদেশের সিনেমা আর সিনেমা হলের মধুর যত অভিজ্ঞতা। ১৮৯৮ সালের ১৭ই এপ্রিল সদরঘাটের পাটুয়াটুলী এলাকার ক্রাউন থিয়েটারে প্রথমবারের মত ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এরপর জগন্নাথ কলেজ, ভিক্টোরিয়া পার্ক সহ অন্যান্য আরো কিছু জায়গায় বিভিন্ন উপলক্ষে সিনেমা প্রদর্শিত হয়। আস্তে আস্তে ঢাকার বুকে বেড়ে ওঠে হলের প্রসার। কি মধুর ছিলো সেই দিনগুলো ! বিশ শতকে ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়ানো সিনেমা হলগুলো সময়ের ব্যবধানে এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে।
কিন্তু কেমন ছিলো সেই সময়ের সিনেমা হলগুলো? তা নিয়েই আমাদের আজকের আর্টিকেল। চলুন জেনে নেয়া যাক, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলের গর্বিত ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা…
ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হল
শাবিস্তান সিনেমা হল : বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল শাবিস্তান এর পূর্ব নাম ছিল পিকচার হাউজ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লেজার নামক একজন ইংরেজ আরমানিটোলায় প্রতিষ্ঠা করেন এই হল। গ্রেটাগার্বোর একটি ছবি দিয়ে এই সিনেমা হলের যাত্রা শুরু হয়। হারিকেন আর লন্ঠন দিয়ে সিনেমা প্রদর্শন করা হত প্রথম দিকে। প্রতিদিন দুইটি করে ছবি দেখানো হত এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবারে দেখানো হত তিনটি করে সিনেমা। আলাউদ্দিন ও আশ্চর্য প্রদীপ, দ্য কিড, মাই ড্যাডি, মহব্বত এমন সব বিখ্যাত সিনেমা দেখানো হয়েছিল শাবিস্তানে। একুশ শতকের শুরুতে এই হল বন্ধ হয়ে যায়।
ব্রিটানিয়া সিনেমা হল : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুলিস্তান মাজারের পাশে নির্মিত হয় ব্রিটানিয়া সিনেমা হল। এখানে শুধুমাত্র ইংরেজি সিনেমা দেখানো হত। যার কারণে ঢাকার শিক্ষিত শ্রেণীর চাহিদার তুঙ্গে ছিল এ হল। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত সিনেমাগুলো প্রদর্শিত হত। ১৯৫০ এর দশকের মঝামাঝি এ হল বন্ধ হয়ে যায়।
সিনেমা প্যালেস (রূপমহল) : বাংলাদেশের দ্বিতীয় সিনেমা হল সিনেমা প্যালেস সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কারো মতে, এই হলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রূপলাল দাস, কেউ বলেন ধীরেন দাশ। মালিকানা পরিবর্তনের সূত্রে এই হলের নামকরণ হয় মোতিমহল। আরো পরে মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জীর মালিকানায় চলে গেলে হলের নতুন নাম হয় রূপমহল। এই রূপমহলেই ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এ সিনেমা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। বিশ শতকের শেষের দিকে এ ঐতিহাসিক সিনেমা হল ভেঙে পরিণত করা হয় বহুতল ভবনে।
প্যারাডাইস টকিজ : ১৯৩৮ সালে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় জেলখানা এলাকার আলী দেউড়ির সাতরওয়াজায় স্থাপিত হওয়া প্যারাডাইজ টকিজ সিনেমা হল পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে পরিচিত হয় ‘প্যারাডাইস’ সিনেমা হল নামে। ফয়েজুদ্দীন নামের এক ব্যক্তি ছিলেন এই হলের প্রতিষ্ঠাকালীন মালিক। ১৯৫৪ সালে আবার হলের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় নিউ প্যারাডাইস। এই হলে প্রদর্শিত প্রথম ছবি ছিল ‘জেলার‘। বর্তমানে হলটি বিলুপ্ত।
গুলিস্তান সিনেমা হল : ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উত্তরে ঢাকা জেলা ক্রীড়া মিলনায়তন ও পল্টন মাঠের পাশে ১৯৫৩ সালে স্থাপিত হয় গুলিস্তান সিনেমা হল। কলকাতার চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজল আহমদ দেশভাগের পর এই হল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এই হলের নাম ছিল লিবার্টি, পরে রাখা হয় গুলিস্তান। শুধুমাত্র এই হলের নামের কারণেই এলাকাটি পরিচিত হয় গুলিস্তান নামে এবং তারই সাথে গড়ে উঠে এক জমজমাট চলচ্চিত্র ব্যবসা। মূলত এটি ছিল ঢাকার শিক্ষিত শ্রেণীর জন্য এক আকর্ষণীয় সিনেমা হল। ইংরেজি ছবি প্রদর্শন ছাড়াও অন্যান্য সব রুচিশীল সিনেমাও এখানে প্রদর্শন করা হত। ১৯৫৩ সালে এখানে দেখানো হয় ডাচ ম্যান, বাবলা, রাজরানি; ১৯৫৪ সালে প্রদর্শিত হয় দি এনসার, আনমোল ঘড়ি; ১৯৫৫ সালে কুইন অফ শিবা, অন্নদাতা, অপবাদ এবং ১৯৫৬ সালে প্রদর্শিত হয় পথের পাঁচালী। ১৯৫৯ সালে এফডিসির সহায়তায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ সিনেমার প্রিমিয়াম অনুষ্ঠিত হয় এই হলে।
লায়ন সিনেমা হল : মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার ইসলামপুরে ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লায়ন সিনেমা হল। প্রতিষ্ঠাকালীন এই হলের নাম ছিল ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার। ১৯২০ এর দশকে মির্জা আব্দুল সর্দার নামের এক ব্যক্তির অধীনে চলে যায় এই হল। প্রথম দিকে নাটকের পাশাপাশি সিনেমা দেখানো হলেও ১৯২৭ সাল থেকে শুধুই সিনেমা প্রদর্শন হতে শুরু করে। ১৯৩১ সালে উপমহাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ প্রদর্শিত হয় এই লায়ন সিনেমা হলে। বিশ শতকের শেষের দিকে সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়।
তাজমহল : ঢাকার মৌলভী বাজার এলাকার দুই ভাই মোখলেছুর রহমান ও আরিফুর রহমান ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তাজমহল নামের এ সিনেমা হল। ১৯৮০’র দশকে এ হল ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়।
আজাদ সিনেমা হল : পুরনো ঢাকার জনসন রোডে জীর্ণশীর্ণ এ হল কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জীর নামানুসারে প্রথম দিকে এর নাম ছিল মুকুল টকিজ। ১৯২৯ সালে ঢাকায় নির্মিত হওয়া প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস এই হলে প্রদর্শিত হয়। ঢাকা শহরের রুচিশীল দর্শক থেকে শুরু করে সব ধরণের দর্শকে সরগরম থাকত আজাদ সিনেমা হল। এই তালিকায় আছেন শামসুর রাহমান, কাইয়ূম চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সৈয়দ শামসুল হকও। ১৯৩০ সালে এই হলে দেখানো হয় চণ্ডীদাস, গোরা, ফেয়ারওয়েল টু আর্মস ইত্যাদি বিখ্যাত সব ছবি। বর্তমানে হলটি কোনরকমে টিকে আছে।
মধুমিতা সিনেমা হল : গত ডিসেম্বরে ৫০ বছরে পা দেয়া ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সালে। বর্তমান হল মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের শিল্পপতি বাবা নিজের ভাল লাগা থেকে গড়ে তোলেন এ সিনেমা হল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার আব্দুল জব্বার খান এই হলের উদ্বোধন করেন। এখানে প্রথম প্রদর্শিত ছবি হচ্ছে ‘ক্লিওপেট্রা’। ১৯৮১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল ব্যাপী চলা ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন হয় এই সিনেমা হলে। পঞ্চাশ বছর পার করে মধুমিতা এখন হারিয়ে বসে আছে তার অতীত জৌলুস।
মানসী সিনেমা হল : ঢাকার বংশালে অবস্থিত মানসী সিনেমা হল বিশ শতকের তৃতীয় দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মালিক ছিলেন বালিয়াটি জমিদার পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে কোনরকমে টিকে আছে এই হল।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পরের ৭০ বছর পর্যন্ত ঢাকার শিল্প সংস্কৃতিতে সিনেমা হলের ব্যাপক দৌরাত্ম্য ছিল। সেই সোনালী অতীত এখন আর নেই। আগেকার মত এখন আর পরিবার ও দলবল নিয়ে টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে যাওয়া হয় না। মানুষের মুখে মুখে ফেরে না তাদের প্রিয় সিনেমার গান। এখন আর প্রিয় নায়কের স্টাইলও অনুসরণ করে না কেউ। দেশীয় নায়কদের প্রিয় বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় সবাই। বাংলাদেশের সিনেমা ও সিনেমা হলের গর্বিত সময় ঠিক কি কারণে অন্ধকার হারিয়ে গেলো, তার ইতিহাস খুঁজতে যেয়ে যারপরনাই ব্যর্থতা ও মুখ থুবড়ে পড়া কর্তৃপক্ষের চিত্র সামনে চলে আসবে।