মুম্বাই বলেন আর বোম্বেই বলেন, আধুনিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের জনক বলতে যারা আসলে দাউদ ইব্রাহীম কে বুঝেন, তারা একটু ভুলই জানেন। মুম্বাইয়ের এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের বর্তমান যে অবস্থা, তার জন্ম হয় প্রথমে হাজী মাস্তান এর হাত ধরে !
আপনারা যারা অজয় দেবগণের Once Upon a Time in Mumbai দেখেছেন এবং যারা অজয় দেবগণের চরিত্র মাস্তান হায়দার মির্জা দেখেছেন, তারা বুঝবেন। এই মাস্তান হায়দার মির্জার চরিত্রটি ছিল আসলে “হাজী মাস্তান” এর আর ইমরান হাশমি অভিনয় করেছিন দাউদ ইব্রাহীমের চরিত্রে। আসুন জেনে নেওয়া যাক আসলে কে ছিলেন এই হাজী মাস্তান…
হায়দার মির্জার জন্ম ১৯২৬ সালে তামিল নাড়ু’র এক দরিদ্র পরিবারে। ৮ বছর বয়সে বাবার সাথে তিনি মুম্বাইতে আসেন। মুম্বাই বন্দরে তিনি দিন মুজুর হিসাবে কাজ করতেন এবং সেই বন্দর থেকেই এক সময় হায়দার মির্জা পরিণত হন হাজী মাস্তান রূপে।
মূলত শুরুটা হয় স্বর্ন চোরাচালানই দিয়ে। মুম্বাইয়ের একপাশে ভারত সাগর আর এই সাগর দিয়েই স্বর্ন চোরেরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাচ্চাদের হাত দিয়ে সোনা এনে দিত ভারতে। হাজী মাস্তান ছিল সেই বাচ্চাদের মধ্যে একজন যে কিনা মুখে করে সোনা নিয়ে আসত বন্দর থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। নিজের বুদ্ধি দিয়ে একসময় যুবক বয়সে তিনি বড় স্মাগলারদের সাথে কাজ করা শুরু করলেন এবং সোনা ছাড়াও আরো অনেক অবৈধ জিনিস স্মাগলিং করা শুরু করলেন। শুধু স্মাগলিং করেই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না, সে স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন মুম্বাইয়ের একজন শাহেনশাহ হবার। আর তাই নিজের একটি দল বানালেন এবং এক এক করে স্মাগলারদের নিজের পথ থেকে সরাতে লাগলেন।
একসময় পুরো মুম্বাইয়ের নিয়ন্ত্রণ হাজী মাস্তানের হাতে চলে আসে। শুরু হয় তার পলিটিশিয়ান এবং হাইক্লাস মানুষদের সাথে উঠাবসা। সেই সময় মুম্বাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাং গুলো একে অন্যের সাথে মারামারিতে লিপ্ত ছিল আর এই সময়টাই ঠিক আমেরিকার LUCKY LUCIANO এর মত করে হাজী মাস্তান সব গ্যাংগুলোকে নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। এরপরেই তিনি এক এক এলাকা একেক গ্যাং এর মধ্যে ভাগ করে দেন। এবং নির্ধারিত জায়গা ছাড়া অন্যকেউ কারো জায়গায় ভাগ বসাবে না এই শর্তে সবাই মারামারি বন্ধ করেন।
ষাট ও সত্তরের দশকে বলিউডের পরিচালকেরা মুভি বানানোর জন্য টাকা পাচ্ছিলেন না। তারা ব্যাংকের সাহায্য নিয়ে মুভিও বানাতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। ঠিক এই সময় হাজী মাস্তান উপস্থিত হন তাদের কাছে ক্যাশ টাকা নিয়ে। হিসাব খুবই সোজা কালো টাকা ট্যাক্স ফ্রি বিনিয়োগ। কাড়ি কাড়ি টাকা মানে পরিচালক ভাল মুভি বানাবে, ভাল মুভি মানে ভাল ব্যবসা, আর ভাল ব্যবসা মানে সুদে আসলে অনেক লাভ…
সেই সময় বিখ্যাত অভিনেতা দিলিপ কুমার, রাজ কাপুর, ধর্মেন্দ্র ছিলেন হাজী মাস্তানের বন্ধু !
তো এই সেলিব্রেটি গ্যাংস্টার শুধু গডফাদার খেতাবটাই পেয়েছিলেন, তা নয়। বেন্দি বাজার, ডংরি, নাগপাড়া এই সকল স্থানে মানুষের অবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ এবং এলাকাগুলোও ছিলো প্রচণ্ড দরিদ্র এলাকা। আর এই জায়গাগুলোতে হাজী মাস্তান ছিলেন রবিনহুড নামে পরিচিত। মানুষ ঝামেলায় পড়লে পুলিশের কাছে না গিয়ে সবাই যেত হাজী মাস্তানের কাছে। চাকরি দরকার হাজী মাস্তান আছে, ব্যবসা করবেন হাজী মাস্তান ঠিক করে দিবে। মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, হাজী মাস্তান সেটার ব্যবস্থা করে দিবেন। গরিব মানুষ, অসুস্থ মানুষ, বিধবা, এতিম থেকে শুরু করে সবার কাছে তিনি ছিল দেবতার মতন।
হাজী মাস্তানের অনেক রকম ব্যবসা ছিল। চোরাচালানি, মদ, স্বর্ণ , রেস্টুরেন্ট, ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি, রিয়েলস্টেট সহ অনেক রকমের ব্যবসা তিনি করতেন। কিন্তু কোনদিন তিনি হেরোইন, কোকেন এসবের ব্যবসা করেননি।
১৯৯৪ সালে তিনি ক্যান্সারের আক্রান্ত হয়ে মারা যান। হাজী মাস্তান নিজেকে “সোলেমান মির্জা” নামে পরিচয় দিতেন। কিন্তু সেখানকার মিডিয়াই তাঁর নাম দেয় হাজী মাস্তান !