পৃথিবীতে এমন কিছু রহস্য বা ভয়ানক কাহিনী রয়েছে যা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। মিসরীয় রাজা-রানীরা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর আত্মা পুনর্জীবিত হয়ে পুনরায় দেহে ফিরে আসে। তাই তাদের মৃত্যুর পর মৃতদেহ মমি করে কফিনে রেখে দেওয়া হতো। এই বিশ্বাসের কারণেই মিশরে গড়ে উঠেছিল আশ্চর্যজনক সব পিরামিড। মমি আজো মানুষের কাছে এক বিস্ময়কর বিষয়। মমি-কে নিয়ে আজো মানুষের মনে রয়েছে হাজারো বিস্ময়। এ মমিকে নিয়ে বেশ কিছু অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনাও রয়েছে। মমির প্রকৃত রহস্য আজও উদঘটিত হয়নি। অবিশ্বাস্য বা কাকতালীয় মনে হলেও তেমনই বেশ কিছু ঘটনা আছে সমাধি সৌধ মমিকে কেন্দ্র করে। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক এবং অভিশপ্ত একটি মমি হচ্ছে ফারাও রাজা তুতানখামেন এর।
ফারাও রাজা তুতানখামেন
মিশরের ফারাও রাজত্বের কনিষ্ঠতম শাসক ছিলেন তুতানখামেন। কিশোর বয়সেই মিশরের সম্রাট হয়ে যাওয়া তুতানখামেন নিয়ে রহস্যের যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই ! নীল নদের বাসিন্দাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, যে বা যারা তুতানখামেন মমিকে বিরক্ত করবে, তাদের মৃত্যু অনিবার্য। এই বিশ্বাসটা গাঢ় হওয়ার পিছনে রয়েছে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা।
মাত্র দশ বছর বয়সে তুতানখামেন রাজ্যের হাল ধরেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩২ থেকে ১৩২৩ সাল পর্যন্ত ছিল তার রাজত্বকাল। ন’বছর সিংহাসন সামলানোর পর খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তরুণ ফারাওয়ের। কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে রয়েছে ব্যাপক রহস্য। মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে পারেননি।
তার মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদের রয়েছে নানা মত। কেউ মনে করেন তুতানখামেন সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলেন। কেউ বা বলেন তাকে খুন করা হয়েছে। কারো মতে ম্যালেরিয়াতে তিনি মারা যান। আবার প্রত্নতত্ত্ববিদদের একাংশ বিশ্বাস করেন, ভারী কিছুতে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন এই ফারাও।
তবে মিশরের অধিবাসীদের অনেকের মনের মধ্যে বারবার একই চিন্তা উঁকি দিচ্ছে তুতানখামেন সমাধি ঘিরে তৈরি হওয়া নানা ভয়ঙ্কর কাহিনী। এই সমাধিতে ঢোকার চেষ্টা করার ফল কখনো ভালো হয় না। তাদের আশঙ্কা, তুতানখামেনের সমাধিতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ফের ১৯২২ সালের মত বিভিষীকাময় ঘটনা আবার ফিরে আসবে না তো ! নতুন করে অভিশাপের ছায়া পড়বে না তো মিশরবাসীদের উপর ! বিজ্ঞানমনস্ক মন এসবকে অস্বীকার করলেও বিশ্বাসকে কি অত সহজে টলানো যায় !
এই মমিকে ঘিরে কী ঘটেছিল ১৯২২ সালে?
প্রাচীন মিশরের মানচিত্র ‘ভ্যালি অভ দ্য কিংস’-এর অবস্থান। নীল নদের পশ্চিম তীরে । থিবস নগরের (আধুনিক লুক্সর) বিপরীতে। এখানেই রয়েছে ফারাও তুতানখামেনের সমাধিসৌধ।
১৯২২ সালে সমাধি সৌধ আবিস্কার পর থেকে তুতানখামুন-এর সমাধিসৌধে অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটছে। যা ‘তুতানখামুন অভিশাপ’ বলে পরিচিত । সমাধি সৌধটি আবিস্কারের সাত সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসে লর্ড কার্নারভন মারা যান। তার গালে মশা কামড়ে ছিল । আর তাতেই ইনফেকশন হয়েছিল। আশ্চর্য এই তুতানখামুন -এর এর মুখোশ খোলার পর দেখা গেল লর্ড কার্নারভন এর গালের যে জায়গায় মশা কামড়ে ছিল তুতানখামুন -এর গালের ঠিক সে জায়গায় মশার কামড়ের দাগ রয়েছে !
লর্ড কার্নারভন মারা যাওয়ার সময় কায়রো শহরে নাকি বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। ঠিক ওই সময়ে লন্ডনে লর্ড কার্নারভন কুকুরটিও (সুসি) মারা যায়। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। তুতানখামেন -এর সমাধি সৌধটি আবিস্কারের দিনই প্রত্নতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার -এর ক্যানারি পাখিকে একটি সাপ খেয়ে ফেলে।
তুতানখামেনের মৃত্যুকে ঘিরে নানা ধোঁয়াশা জাল তৈরি হলেও মমি আবিষ্কারের পর তাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল যেন আরো বেড়েই চলেছে। কারণ ব্রিটিশ হাওয়ার্ড কার্টার ও জর্জ হার্বার্ট নামের দুই প্রত্নতত্ত্ববিদের নেতৃত্বে তুতানখামেনের মমি আবিষ্কারের সময় তার সমাধি প্রায় অক্ষত অবস্থায় ছিল। কিন্তু মৃতদেহটি মোটেও অক্ষত ছিল না।
কালো হয়ে পুড়ে গিয়েছিল তুতানখামেনের দেহ। ছিল অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন। তা দেখে মিশরের একদল গবেষক দাবি করেছিলেন, সমাহিত করার আগে রহস্যজনকভাবে আচমকা আগুনে লেগে যায় মৃতদেহতে। তবে এই পুড়ে যাওয়ার কারণ কী, তা নিয়েও রয়েছে একাধিক মত। কারও মতে, মমি তৈরিতে যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হতো, তার বিক্রিয়াতেই ঘটে এই দুর্ঘটনা। আবার কারো মত, দীর্ঘদিন ধরে বিষ প্রয়োগে খুন করা হয়েছিল এই সম্রাটকে। আর সে বিষের কারণেই কালো হয়ে যায় তার গায়ের রং। ঐ রং দেখেই পোড়া বলে ভ্রম হয় গবেষকদের।
খুন নাকি দুর্ঘটনা তা নিয়ে আবার শুরু হয় নয়া বিতর্ক! এ ঘটনার আরো বেশ কিছুদিন পর মিশরের তুতানখামেন-বিশেষজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ক্রিস নাউনটন জানান যে, তুতানখামেনের যে খুনের তত্ত্ব প্রচলিত ছিল, তা সঠিক নয়। বরং তার গবেষণা বলছে, যুদ্ধের ময়দানে কোনো ভাবে ঘোড়া গাড়ির তলায় চাপা পড়েছিলেন তুতানখামেন। তাতেই তার মৃত্যু হয়।
এজন্য একাধিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছিলেন বলে জানান ক্রিস। প্রথম দিকে কৌতূহলের বশেই ময়না-তদন্ত করান তুতানখামেনের মমিটির। বাদ পড়েনি এক্স-রে, সিটি স্ক্যানের মতো আধুনিক পরীক্ষাও। তারপরই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন তত্ত্বটি তুলে ধরেন ক্রিস। ক্রিসের মতে, ঘোড়ার গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন তুতানখামেন। আর তাতেই সম্পূর্ণ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল দেহটি। চাকার তলায় ভেঙে গিয়েছিল বাঁ-হাত। ভেঙে গিয়েছিল বুকের হাড়ও। টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল মাথার খুলি। এহেন ক্ষতবিক্ষত দেহ সমাহিত করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল বলেই ধারণা ক্রিসের। ডি.এন.এ. পদ্ধতির সাহায্যে তুতানখামেন দেখতে কেমন ছিলেন, নাউনটন তাও বের করবার চেষ্টা করছেন বলে জানানো হয়।
মিশরের বেশিরভাগ পিরামিডে থাকা মূল্যবান সম্পত্তি লুঠ হয়ে গেলেও তুতেনখামেনের সমাধিতে পাওয়া গিয়েছিল বিপুল সম্পত্তি ও পাকা সোনা দিয়ে বানানো রত্নখচিত মুখোশ।
মুখোশটি কায়রো সংগ্রহশালায় বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে যা এখন পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল বেশ কিছু নানা গুরুত্বপূর্ণ দলিল যা মিশর সভ্যতার ইতিহাসে এক নয়া দিগন্তের সূচনা করবে বলে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদদের অভিমত।