মানবজাতির উদ্ভাবনশীল ও সৃজনশীল চিন্তাধারা হাজারো যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্ম দিয়েছে। আর এই আবিষ্কারগুলো রুপ দিয়েছে আমাদের বর্তমান সভ্যতার। তবে সব ধরণের যুগান্তকারী আবিষ্কার আলোর মুখ দেখেছে, এমনটা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তবে তাদের ভ্রান্তি দূর করা উচিত। ইতিহাস গবেষণাবিদরা ধারণা করেন, মানব সভ্যতার উপকারে যত আবিষ্কার ব্যবহৃত হচ্ছে বা হয়েছে, তার থেকে বহুগুন বেশি আবিষ্কার হারিয়ে গেছে কালের অতলে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আবিষ্কারকের ব্যর্থতা আর সময়ের অনুপযোগীতার মত বিষয় গুলো ভূমিকা রেখেছে। এমন হারিয়ে যাওয়া আবিষ্কারগুলো ও তাদের আবিষ্কারকের পরিচিতি নিয়েই ছারপোকার আজকের এই পোস্ট !
১. বেতার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা : নিকোলা টেসলা বিপ্লবী একজন উদ্ভাবক ছিলেন যার একার হারিয়ে যাওয়া উদ্ভাবন দিয়েই এই পুরো প্রতিবেদনটি লেখা সম্ভব। তবে এখানে স্থান করে নিয়েছে এমন একটি বিপ্লব যা আমাদের চিন্তার পরিসরকেই নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারতো। টেসলা জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেন কোন ধাতব তার ব্যবহার না করেই তড়িৎ শক্তি স্থানান্তর করার কৌশল আবিষ্কার করতে। এর ফলস্রুতিতে উদ্ভব হয় টেসলা কয়েলের। টেসলা কয়েল সীমিত দূরত্বের মধ্যে উচ্চমাত্রা AC বিভব উৎপাদন করে তা বাতাসের মধ্য দিয়ে স্থানান্তর করতে পারতো। টেসলা এমন একটি ভবিষ্যৎ কল্পনা করতেন যেখানে আকাশ থেকে তড়িৎ শক্তি ছড়িয়ে পরবে আর আমাদের কিঞ্চিত ছোট মোবাইলের চার্জারের তারের সমস্যা চির দিনের মত বিলুপ্ত হবে। যেহেতু এই প্রণালীতে ব্যবহারকারীদের হিসাব রাখা কঠিন তড়িৎ উৎপাদক কোম্পানীদের জন্য। তাই এর গবেষণা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভুগতে ভুগতে হারিয়ে যায়।
২. ভেস্ট পকেট টেলিফোন : মটোরোলা প্রথম মোবাইলের প্রচলনের ৬৭ বছর আগে নিউ ইয়র্কে ১৯০৬ সালে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে এমন টেলিফোনের প্রচার হয় পত্রিকায়। মার্কোনি সিস্টেমের মত বেতার ব্যাটারী আর টেলিফোন তারের সিগন্যাল প্রসেসিং পুঁজি করে তৈরি হয়েছিল ডিভাইসটি।
চার্লস আ্যলডেন সাময়িক খ্যাতি পেলেও তার আবিষ্কার অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে যায়। তবে তার সম্পর্কে ভাবতে গেলে এইটুকুই স্পষ্ট মোবাইল ফোন আবিষ্কৃত হবার ৬০ বছর আগ থেকে মানুষের মনে এর চাহিদা জন্ম নেয়। ১৯০০ শতকের শুরু থেকে আমাদের হাতে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে এখন আমাদের গবেষণা কোন পর্যায়ে থাকত, তা কেবল কল্পনাই করতে পারি আমরা।
৩. ভেপার কার্বোরেটর : থমাস ওগল এর আবিষ্কৃত এই যন্ত্রটি শক্তি গবেষণায় বিপুল আলোচনায় আছে ১৯৭০ সাল থেকে। একাধিক বিবৃতিতে রয়েছে তিনি এমন কার্বোরেটর আবিষ্কার করেন যা ব্যবহার করলে ১ গ্যালন জ্বালানী খরচ করে ১০০মাইল (১৬০ কি.মি) দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব। আবিষ্কারটি পেটেন্ট আইনে সুরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও ১৯৮১ সালে ওগলের মৃত্যুর সাথে হারিয়ে যায় কার্বোরেটরের নীল নকশা। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ড্রাগ ওভার ডোজ লেখা হয় ময়না তদন্তের বিবৃতিতে। তবে অনেকের ধারণা তার মৃত্যু হয় বিষ্ক্রিয়ায়। তারপর বহু চেষ্টা করেও কার্বোরেটরটি পূনর্নিমাণ সম্ভব হয়নি যার ফলস্রূতিতে অনেকেই মনে করেন প্রতারণা বই ছাড়া অন্য কিছু ছিল না এই কার্বোরেটরটি। প্রতারণা হয়ে থাকলে কোন আফসোস করার কারণ নেই। যদি বাস্তব হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে বর্তমান কালের জ্বালানী সমস্যার সমাধানটা হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে।
৪. গ্রিক আগুন : নেপাল্ম বর্তমানকালের আবিষ্কৃত অন্যতম বিভৎস একটি সামরিক অস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ আর ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত ফ্লেম থ্রোয়ার এর জ্বালানী ছিল নেপাল্ম। তবে এর পরিকল্পনা আর প্রয়োগ আদিম গ্রীক সভ্যতায় পাওয়া যায় ১৩০০ বছর আগে থেকেই।
পাইন নির্যাস, ন্যাপথা, কুইকলাইম, ক্যালসিয়াম ফস্ফাইড আর সালফারের একটি মিশ্রণ কে ধারণা করা হয় গ্রীক ফায়ারের উপকরণ। তবে কোন লিখিত প্রস্তুত প্রণালী খুঁজে পাওয়া যায় নি। যারা এর প্রকোপ দেখেছেন বা শুনেছিলেন তাদের জন্য এক বিভিষিকা ছিল এই গ্রীক আগুন। যুদ্ধ বিগ্রহের উদ্দেশ্য বিপ্লবী আবিষ্কার হলেও, হারিয়ে যাওয়াটাই গ্রীক আগুনের জন্য উপযুক্ত পরিণতি।
৫. ওলেস্ট্রা : খাবার নিয়ে সচেতনতা এখন গতানুগতিক জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাস্থ্য সচেতনতার এই স্বর্ণ যুগে অনেককেই বলতে শোনা যায় “ইস, ইচ্ছামত যদি খেতে পারতাম ওজন বাড়ার চিন্তা না করে”। এমন বিপ্লবী স্বাস্থ্যসম্মত খাবার হিসেবে প্রচলন হয় ওলেস্ট্রার। এটি ভোজ্য তেল-চর্বির একটি বিকল্প হিসেবে বাজারে আসে। ওলেস্ট্রার বৈশিষ্ট্যই ছিল কোন প্রকার ওজন বৃদ্ধিকারি উপাদান নেই এতে। ১৯৬৮ সালে একটি রাসায়নিক দূর্ঘটনায় এর উদ্ভব হয়। মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাটাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ছিল এই বিপ্লবী উৎপাদের। মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে যখন FDA বাজারজাতকরণের আগে ওলেস্ট্রার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলো মোড়কে উল্লেখ করে। যার একটি হল পায়ু পথের নিয়ন্ত্রণহানী। কল্পনাই করতে পারছেন ভোজ্যতেলের গায়ে এমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া লেখা থাকলে তার পরিণতি কেমন হতে পারে। বাজারেই পড়ে থাকে শত শত ওলেস্ট্রার ক্যান। কোন ক্রেতা এমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যায় নি। তবে মোড়ক থেকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলো সরানো হলেও ওলেস্ট্রাকে জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়নি। যার দরূন এখনও আমরা আমাদের পরিবারের সবার সাথেই দিব্যি অস্বাস্থ্যকর পাম/ ভেজিটেবল ওয়েল দিয়ে খাবার গ্রহন করছি।
৬. স্লুট ডিজিটাল কোডিং : অনন্তকাল অবধি ফাইল আপলোড লো স্পীড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য এক নির্মম বিভিষিকা। ফাইল সাইজ আর ট্রান্সফার স্পীড এর বেড়া জালে আটকে থাকে নানা ধরণের প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কাজ। ১৯৯০ সালে ডাচ নাগরিক ইয়ান স্লুট একটি নতুন ফাইল সিস্টেমের ঘোষণা দেন যা ফাইল স্টোরেজ আর ট্রান্সফারের জগৎ কে চিরতরে বদলে দিতে পারবে। তার সিস্টেম একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কে মাত্র ৮ কিলোবাইট স্পেসে সংরক্ষণ করতে পারে। ফিলিপ্স কোম্পানির এক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সামনে ইয়ান ৬৪ কিলোবাইট একটি মেমোরী কার্ড থেকে ১৬ টি চলচ্চিত্র দেখাতে সক্ষম হন। এই সিস্টেমটির সকল তত্ত্ব খোলাশা করার আগের দিন একটি দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন ইয়ান। ফাইল সিস্টেমের সোর্স কোড উদ্ধার করা গেলেও একটি জরুরী কম্পাইলার কোড সম্বলিত ফ্লপি হারিয়ে যাওয়ায় সিস্টেমটি আর সচল করা সম্ভব হয়নি। একটি ফ্লপি ডিস্কের সাথে হারিয়ে গিয়েছে এ যাবৎকালের তথাকথিত সেরা ফাইল সিস্টেম।
৭. স্টারলাইট : পারমাণবিক বিস্ফোরণের ভয়াবহতা সহনশীল একটি পদার্থের খোঁজ মানুষের অনেক দিনের। হিরোশিমা আর নাগাসাকির মর্মান্তিক সে দিন গুলোর পর থেকে পৃথিবীজুড়ে খোজ শুরু হয় বিপ্লবী একটি পদার্থের যা পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে নিরাপত্তা দিতে পারবে। এমনই পদার্থ স্টারলাইট। ১০০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল এই পদার্থের আবিষ্কার করেন মরিস ওয়ার্ড। কয়েকটি পরীক্ষায় পদার্থটি একটি কাঁচা ডিম কে উক্ত তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। NASA আর পেন্টাগনে বহুল আলোচনার জন্ম দেয় পদার্থটি। আবিষ্কারের সত্ব চুরির ভয়ে মরিস আতংকগ্রস্থ থাকতেন। ফলে ২০১১ সালে তিনি যখন মারা যান তার সাথে অন্তিম শয্যায় চলে যায় স্টারলাইটের উৎপাদন প্রণালী। বর্তমানে নাসার কাছে জমা দেয়া নমুনাগুলো থেকে বিপরিত কৌশলে প্রণালীটি উদ্ধারের ব্যাপারেও রয়েছে আইনী বাধা। তাই স্টারলাঈট সত্যিকার অর্থে কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া সাত রাজার গুপ্ত সম্পদ।
৮. সিলফিয়াম : রোমান সভ্যতা মুক্ত চিন্তা আর গবেষণার জন্য প্রসিদ্ধ। তাদের উদ্ভাবনশীলতার নমুনা হিসেবেই এই প্রতিবেদনে স্থান করে নিয়েছে সিলফিয়াম। বীর্যনাষক জন্মবিরতিকরণ ঔষধের প্রথম নিদর্ষণ এই সিলফিয়াম। সেকাল থেকেই রোমানদের প্রয়োজন ছিল জন্মবিরতিকরণের। অতিরিক্ত বড় পরিবার তাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি বিষয় ছিল। কনডমের প্রচলন হলেও ব্যয়বহুল আর অপূনর্ব্যবহারযোগ্য ছিল বলে সিলফিয়াম বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সিলফিয়াম ছিল গুল্ম জাতীয় একটি উদ্ভিদের ঘনীভূত নির্যাস। বিপুল জনপ্রিয়তা সত্বেও, উদ্ভিদটি আফ্রিকান উপকূল ব্যতিত অন্যত্র চাষ সম্ভব ছিল না যার ফলে ধীরে ধীরে প্রচলন কমে যেতে থাকে সিলফিয়ামের। ২০০০ হাজার বছর আগেই যদি ১৯৬০ সালের বিপ্লবের মত জন্মবিরতিকরণ জনপ্রিয়তা পেত তবে পৃথিবীর জনসংখ্যা সমস্যা অনেক খানি কমে যেতে পারতো।