ডাইনোসর (Dinosaur) বলতে কোন বিশেষ প্রাণীকে বোঝায় না, বরং প্রায় হাজার রকমের প্রাণীর একটা দলকে বোঝায়। ডাইনোসরের কথা আমরা জানতে পেরেছি মাত্র আড়াইশ বছর আগে। কিন্তু এরা পৃথিবীতে এসেছিল মানুষের জন্মের বহু আগে, আজ থেকে প্রায় ১৬ কোটি বছর আগে। তারপর প্রায় ১০ কোটি বছর ডাইনোসর পৃথিবীর জল ও স্থলভাগে রাজত্ব করেছে। ডাইনোসরদের এ সময়টাকে জুরাসিক যুগ (Jurassic Period)।
ডাইনোসরের প্রকারভেদ
কিছু ডাইনোসর ছিল মাংসাশী, যেমন টাইরেনোসরাস (Tyrannosaurus), আবার কিছু ছিলো তৃণভোজী, যেমন স্টেগোসরাস (Stegosaurus)। কিছু ডাইনোসর হতো দুই পায়ের আবার কিছু ছিল চারপাওয়ালা। মানুষের চেয়ে বড় ডাইনোসর যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো মানুষের চেয়ে ছোট ডাইনোসর। যেমন:- কম্পসোগ্নাথাস (Compsognathus) এর আকৃতি ছিল মুরগির মতো এবং হেটারোডন্টোসরাস (Heterodontosaurus) ছিল বড় কুকুরের সমান লম্বা। বেশির ভাগ ডাইনোসরই বাসা বানাত এবং ডিম পাড়ত। তাই বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরকে পাখি এবং সরীসৃপদের আদি পুরুষ বলে থাকেন। ডাইনোসরদেরও প্রধান দুটো ভাগ ছিল ওরনিথিশিয়ানস বা পাখি-জাতীয় এবং সোয়ারিশিয়ানস বা সরীসৃপ-জাতীয়।
ডাইনোসর আবিষ্কার ও সন্ধান
ফসিল আবিষ্কারের মাধ্যমে ডাইনোসরের কথা প্রথম জানা যায় সতেরো শতকে। ১৮২০ সালে ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম বাকল্যান্ড (William Buckland, 1748-1856) সর্বপ্রথম ডাইনোসরকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করেন। ১৮৪২ সালে জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়েন (১৮০৪-১৮৯২) সর্বপ্রথম ‘ডাইনোসর’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এখন পর্যন্ত ভারত, চীন, মাদাগাস্কার, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এন্টার্কটিকায় ডাইনোসরের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ডাইনোসরের ফসিল বা জীবাশ্ম থেকে জানা যায়, সেটি কত পুরোনো, কোথায় বাস করতো, দেখতে কেমন ছিল, কি খাবার খেত ইত্যাদি।
টি. রেক্স ডাইনোসর
এই বিশালাকৃতির ডাইনোসরটি ছিলো সর্ববৃহৎ মাংসাশী ডাইনোসর। বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত এর চেয়ে বড় মাংসাশী প্রাণীর সন্ধান পাননি। ১৮৭৪ সালে উত্তর আমেরিকার কলোরাডোতে সর্বপ্রথম এর ফসিল আবিষ্কৃত হয়। এখন পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি টি. রেক্স বা টাইরেনোসরাস রেক্স (Tyrannosaurus Rex) এর ফসিল পাওয়া গেছে।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে টাইরেনোসরাস রেক্স পৃথিবীতে বাস করত বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। ফসিল গবেষণায় দেখা গেছে, টাইরেনোসরাস রেক্স ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা এবং ১৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু ছিল। এর দাঁত ছিল প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা। একটি প্রাপ্তবয়স্ক টাইরেনোসরাস রেক্স-এর ওজন ছিল অনেক- প্রায় ১০ হাজার কেজি।
বেরিওনিক্স ডাইনোসর
ইংল্যান্ডের সারেতে ১৯৮৩ সালে একটি ডাইনোসরের নখ ও হাড়ের ফসিল পাওয়া যায়। ডাইনোসরটির নাম দেওয়া হয় বেরিওনিক্স। ডাইনোসরটির পাকস্থলীতে মাছের ফসিলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন বেরিওনিক্স ছিল মাছখেকো। আজ থেকে প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে এদের অস্তিত্ব ছিল।
প্রোটোসিরেটপস ডাইনোসর
১৯২০ সালে মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমিতে প্রকৃতিবিদ রয় চ্যাপম্যান এন্ড্রুজ (১৮৮৪-১৯৬০) সর্বপ্রথম এই ডাইনোসরটির হাড় ও ডিমের ফসিলের সন্ধান পান। প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে প্রোটোসিরেটপসরা পৃথিবীতে বসবাস করত। এরা ২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতো। এরা ছিলো অনেকটা ভেড়ার মতো দেখতে; এদের ছিল লম্বা ঘাড় ও ঘাড়কে রক্ষা করার জন্য ঘাড়বেষ্টনী।
ডাইনোসর যুগের অবসান
প্রায় ৬ কোটি বছর আগে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হঠাৎ করে ডাইনোসরদের এ রকম নিশ্চিহ্ন হওয়াটা বিজ্ঞানীদের কাছে আজও এক বিরাট রহস্য।
কীভাবে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল, সেটা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা আছে। অনেকেই ধারণা করেন পৃথিবীর সাথে কিছু বড় উল্কাপিণ্ডের সংঘর্ষ হয়। ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দীর্ঘকালের জন্য ঘন মেঘে ঢেকে যায় এবং সূর্য আড়াল হয়ে যায়। ফলে সূর্যালোকের অভাবে ডাইনোসরসহ সে সময়ের বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়। অনেকে আবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, টিকে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা ইত্যাদিকে ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ বলে মনে করেন।
ডাইনোসর সম্পর্কিত মজার তথ্য
- স্থলচর, জলচর এবং পাখি মিলিয়ে ডাইনোসরের প্রায় ৯০০০ প্রজাতি ছিল বলে ধারণা করা হয়।
- সবচেয়ে ছোট ডাইনোসরটির নাম হলো স্যাল্টোপাস (Saltopus)। এটি ছিল তিন ফুট লম্বা আর ওজনে মাত্র পাঁচ পাউন্ড!
- শুধু স্থলে নয়, জলেও ছিল ডাইনোসরদের অবাধ বিচরণ। জলজ ডাইনোসরগুলোও ছিল বিশালাকৃতির-বর্তমানের তিমি বা হাঙর থেকেও বড়। আবার ছোট জলজ ডাইনোসরও ছিল!
- কিছু কিছু ডাইনোসরের যেমন ছিল সাপের মত শীতল রক্ত, তেমনি কয়েক ধরনের ডাইনোসরের ছিল মানুষের মতো উষ্ণ রক্ত। তবে তাদের বুদ্ধি ছিল খুবই কম!
- সবচেয়ে বড় ডাইনোসরটির নাম ‘সরোপড’। এরা ছিল তৃণভোজী। এদের উল্লেখযোগ্য একটি প্রজাতি-ডিপ্লোডোকাস। এর দৈর্ঘ্য ২৭ মিটার এবং ওজন প্রায় পনের হাজার কেজি পর্যন্ত হতো!
- সরীসৃপজাতীয় ডাইনোসরগুলো ছিল বর্তমানের ডাইনোসরদের মতোই। সাপ, কুমির, টিকটিকির মতো তাদের ও ছিল আঁশওয়ালা চামড়া। তারা ডিম পাড়ত। তবে তাদের পা ছিল অনেক লম্বা। ফলে তারা এখনকার সরীসৃপদের তুলনায় অনেক দ্রুত চলাচল করতে পারত!
সবশেষে একটা প্রশ্ন কিন্তু এখনো থেকেই যায়, ডাইনোসর বলে সত্যিই কি কিছু ছিলো কখনো? যার উত্তর দিতে গেলে ‘ছিলো’র পাল্লা ভারী হলেও না থাকার সম্ভাবনাও বেশি !