কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহাল থাকার পরেও জেল ভেঙে আসামীর পালিয়ে যাওয়াটা তেমন কোনো অবাক করা বিষয় নয়, বরং একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তবুও ইতিহাসে এমন কিছু জেল ভাঙার ঘটনা রয়েছে যা বেশ আলোচিত-সমালোচিত কিংবা বিখ্যাত অথবা কুখ্যাতও বলা যেতে পারে। কিছু কিছু আসামীর পালিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি এতোটাই রোমাঞ্চকর ছিলো যে, সেসব ঘটনার উপর নির্ভর করে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় নাটক সিনেমা কিংবা ডকুমেন্টারী নির্মাণ করা হয়েছে।
সেরকমই অদ্ভুত ও চাঞ্চল্যকর কিছু জেল পালানো আসামী আর তাদের পালিয়ে যাবার গল্প বলবো আজ…
১. জন ডিলিঞ্জার – উনি ছিলেন তার সমসাময়িক সময়ের সবচেয়ে কুখ্যাত ব্যাংক ডাকাত। তার সময়ের রেকর্ড পরিমান অর্থের মালিক এই ডিলিঞ্জার সাহেব একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যার দায়ে ১৯৩৪ সালে গ্রেফতার হন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ঘোষনা দিয়ে তাকে জেলখানায় পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে কি, এতো নামী একজন লোকের জীবন তো আর এভাবে জেলখানায় বন্দী হয়ে শেষ হয়ে যেতে পারেনা, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জেল থেকে পালাবেন। তাও আবার খুব সহজ এবং নিশ্চয়তার সঙ্গে। তিনি একটা কাঠের তক্তা কেটে পিস্তলের আকৃতি তৈরী করলেন। তারপর তাতে জুতার কালি মাখিয়ে একদম হুবহু পিস্তলের মতো বানিয়ে ফেললেন। তারপর আর কি, একজন কারারক্ষী’র কপালে সেই কাঠের পিস্তল ঠেকিয়ে সিনেমার নায়কের মতো পালিয়ে গেলেন জেল থেকে।
সে যাত্রায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তার মুক্ত জীবন খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কয়েকমাস পর ডিলিঞ্জার সাহেব তার গার্লফ্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সিনেমা হলে। তিনি তো আর জানতেন না যে তার আগেই সেখানে উপস্থিত ছিলো FBI’র বেশ কয়েকজন সিক্রেট এ্যজেন্ট। ডিলিঞ্জার সেখানে পৌঁছানোর সাথেসাথেই তারা কোনরকম ড্রামা না করে ডিরেক্ট তাকে গুলি করে। পরপর তিনটা গুলি তার পিঠে লাগে এবং হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বেই রোগীটি অর্থাৎ জন ডিলিঞ্জার মারা যায়।
২. জোয়েল ডেভিড ক্যাপলান – ১৯৬২ সালে আমেরিকান ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ক্যাপলান সাহেব গ্রেফতার হন। অপরাধ, তার ব্যবসায়ী সঙ্গীকে খুন। যদিও আদালতে তিনি নিজের বিরুদ্ধে আনা অপরাধ অস্বীকার করেছিলেন, কিন্তু সমস্ত তথ্য প্রমান তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ায় তাকে ২৮ বছর কারাদণ্ডের রায় দেয় আদালত।
ভাইকে মুক্ত করার উপায় বের করেন ক্যাপলান সাহেবের বোন, তাও মাত্র ১০ সেকেন্ডে। টেলিফোনে সব প্ল্যান সেরে নেয় দুই ভাই-বোন। একটা Bell-47 হেলিকপ্টারকে রং করা হয় একদম পুলিশী কপ্টারের মতো। তারপর নির্ধারিত দিনে সেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ল্যান্ড করে স্যান্টা মার্টা জেলখানার আঙ্গিনায়। মুহূর্তকালের মধ্যেই জোয়েলকে বসিয়ে হেলিকপ্টারটি আবার উড়াল দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের নিরাপত্তাকর্মীরা গুলি চালাতেও ভুলে যায়। এই ঘটনাকে পরবর্তীতে শতাব্দীর সেরা জেল ভাঙার খেতাব দেয়া হয়।
৩. এ্যলকাট্রাজ থেকে মুক্তি – আমেরিকার সান-ফ্রান্সিসকো’র এ্যলকাট্রাজ দ্বীপের জেলখানাটি ছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জেলখানা, যেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব বলে ধরা হতো। এ্যলকাট্রাজ জেলেখানাটি মাত্র ২৯ বছর চলমান ছিলো, এবং সেসময়ে আমেরিকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের নিবাসস্থল ছিলো এটি। এখান থেকে ২৯ বছরে ৩৬ জন অপরাধী বিভিন্ন সময়ে মোট ১৪ বার পালানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। সফল হয় মাত্র একবার, এবং পরবর্তীতে সেই একবারের লজ্জায় বন্ধ করে দেয়া হয় এ্যলকাট্রাজ জেল।
১৯৬২ সালের জুন মাসের ১১ তারিখ, এ্যলকাট্রাজ কলঙ্ক নামে অভিহিত এই দিনে এখান থেকে পালিয়ে যায় তিনজন আসামী। ফ্র্যাঙ্ক মরিস, জন এ্যঙ্গলিন এবং তার ছোট ভাই ক্ল্যারেন্স এ্যঙ্গলিন। মাত্র ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এই তিন ব্যাংক ডাকাত ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো সমুদ্রবেষ্টিত এ্যলকাট্রাজ দ্বীপ থেকে পালিয়ে গিয়ে। মাসের পর মাস তারা ধাতব চামচ দিয়ে কংক্রিটের দেয়াল খোদাই করে একটা ড্রেন লাইনের ভিতর প্রবেশ করে। সেখান থেকে কিভাবে তারা কোথায় পালায়, কোথায় পৌঁছায় তা আজও অব্দি জানা যায়নি। পালানোর আগে তারা সাবান, টয়লেট টিস্যু, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের মুখের অবয়ব তৈরী করে বিছানায় চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো নিরাপত্তাকর্মীদের ধোঁকা দেয়ার জন্যে।
বর্তমানে এই জেলখানাটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে পর্যটনকেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ দর্শনার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটে এই জেলখানায় এবং এটিই বর্তমানে সান-ফ্রান্সিসকো’র সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র।
৪. মিশেল ভ্যাজর – পালানোর রাজা নামে বহুল আলোচিত এই ব্যক্তি মোট ২৭ বছর জেলখানায় কাটিয়েছেন। এই সময়কালে ৫ বার সে জেল থেকে পালাতে সমর্থ হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো তার শেষ চেষ্টা। অস্ত্রের মুখে ডাকাতি এবং হত্যা চেষ্টার অপরাধে সে বার তার ১৮ বছরের সাজা হয়েছিলো। এসময় তার প্রিয়তমা স্ত্রী নেডাইন এগিয়ে আসেন স্বামীকে উদ্ধারের চেষ্টায়। তিনি প্রথমে হেলিকপ্টার চালনার উপর প্রশিক্ষণ নেন। তারপর নির্ধারিত সময়ে হেলিকপ্টার নিয়ে জেলখানায় পৌঁছে নিচে একটা মোটা দড়ি নিক্ষেপ করেন। মিস্টার মিশেল সেই দড়ি ধরে পালিয়ে যান।
অবশ্য সেই বছরেই তিনি আবার ধরা পরেন পুলিশের হাতে। এবার পুলিশের গুলি এসে সরাসরি তার মাথায় আঘাত করে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে কোমায় থাকার পর যখন তিনি সুস্থ্য হন, তখন আবার তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে নির্ভেজালে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কারাবাস করার পর অবশেষে তিনি মুক্তি পান।
৫. জ্যোয়াকোয়েন ‘এল চ্যাপো’ গ্যুজমান – মেক্সিকোর সবচে’ ভয়ঙ্কর একটা অপরাধ চক্রের গুরু এই এল চ্যাপো। কিছু সমীক্ষণের হিসাব মতে এল চ্যাপো হচ্ছেন গত শতাব্দীর সবচে’ ধনী অপরাধি। আমেরিকান ফোর্বস্ ম্যাগাজিনের মতে ২০০৯ থেকে ১১ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার এল চ্যাপো পৃথিবীর সবচে’ ক্ষমতাধর ১০০ ব্যাক্তির তালিকায় যথাক্রমে ৪১,৬০ ও ৫৫ তম হন। সে মেক্সিকোর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর এবং প্রথম ১০ জন ধনীর একজন ছিলেন। স্মাগলিং, কিডন্যাপিং, খুন, ড্রাগডিলিং সহ হেন কোনো অপরাধ নেই যা তিনি করেননি কিংবা করাননি।
ধরা পরার পর তাকে রাখা হয় মেক্সিকোর গ্রান্ড প্রিজনে, যেখানে ছিলো ওই দেশের সবচেয়ে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী যেখান থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব। তবুও তিনি সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন, এবং অসম্ভবকে প্রায় সম্ভব করে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে ধরা পরে যান তিনি। পরবর্তীতে তাকে আল্ট্রা প্লানার নামক কারাকক্ষে বন্দী রাখা হয়। বছর খানেক পর সেখান থেকে তিনি পালিয়ে যান। তার কারাকক্ষের মেঝেতে প্রায় এক মাইল লম্বা সুরঙ্গ পাওয়া যায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিনি আবারো পুলিশের হাতে ধরা পরে বর্তমানে কারাবন্দী অবস্থায় আছেন।
কে জানে, যখন আপনি এই পোস্টটি পড়ে সময় নষ্ট করছেন তখন হয়ত পৃথিবীর অপর প্রান্তে এল চ্যাপো সাহেব জেল পালানোর নতুন ফন্দী আঁটছেন!