পৃথিবী থেকে স্বচোখে দেয়া পৃথিবীর নিজস্ব উপগ্রহ চাঁদ নিয়ে মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ সেই প্রথম থেকেই। চাঁদকে মুঠোয় পুড়ে নেবার মন্ত্রেই যেনো শূন্যের পথে মানুষের বিজয়রথ শুরু হয়েছিল। আর একটা সময় মানুষ ঠিকই পা রেখেছে স্বপ্নের সেই চাঁদের দেশে। ১৯৫৮ সালে রাশিয়ার স্পুটনিক স্যাটেলাইটের পরেই পরাশক্তিধর আমেরিকা আচমকাই ঘোষণা দিয়ে বসে চন্দ্র অভিযানের ! অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্র অভিযানের সাফল্য অ্যাপোলো ১১ এর মাধ্যমে।
১৮৬৫ সালে সাহিত্যিক জুলভার্ন ‘ফ্রম আর্থ টু দ্যা মুন’ নামে একটি সাহিত্য রচনা করেন। এই কল্পকাহিনীতে একটি মহাকাশযান অ্যামেরিকার ফ্লোরিডা থেকে যাত্রা শুরু করে চাঁদে অভিযান শেষে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে। জুলভার্নের এই সাহিত্য থেকে তৈরি হয় নির্বাক চলচ্চিত্র ‘এ ট্রিপ টু দ্যা মুন’ যা ১৯০২ সালে মুক্তি পায় আর মানুষ স্বাদ পায় চন্দ্রজয়ের !
কিন্তু সব কল্পনা বাস্তবে রুপ পায় ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই আন্তর্জাতিক সময় ০২:৫৬ তে, যখন মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখেন। সেই থেকে দিনটি বিজ্ঞান আর মানবসভ্যতার জন্য চিরস্মরণীয় একটি দিন।
পৃথিবী থেকে চাঁদ জয়ের যাত্রা কারিগরি দিক থেকে অত্যন্ত জটিল আর দুরূহ ছিলো নিঃসন্দেহে। অভিযানটি বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিলো। যেমনঃ নকশা, পরীক্ষা, রকেট তৈরি করা, রকেট ও মহাকাশযান শুন্যে উৎক্ষেপন, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে চাঁদের অভিমুখে যাত্রা, চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ, আবার নিরাপদে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন।
মিশন অ্যাপোলো ১১
অ্যাপোলো ১১ ছিলো অ্যাপোলো মিশনের ৫ম অভিযান। প্রথম মানব হিসেবে নীল আর্মস্ট্রং এর চাঁদে পদার্পণ করবার প্রায় ২০ মিনিট পর বাজ অলড্রিন চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করেন দ্বিতীয় মানব হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক রীতি অনুযায়ী, কোনো অজানা জায়গায় মিশনের কমান্ডার প্রথমে প্রবেশ করেন না। সে হিসেবে পাইলট অলড্রিনেরই প্রথম চাঁদে পা রাখার কথা। কিন্তু দুই নভোঅভিযাত্রীর কেউই এ ব্যাপারে ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না স্বাভাবিকভাবেই। শেষ পর্যন্ত নাসা সিদ্ধান্ত নেয় যে সিনিয়র হিসেবে আর্মস্ট্রংই এই বিরল সম্মান পাবেন। তাদের অপর সঙ্গী মাইকেল কলিন্স তখন চাঁদের কক্ষপথে সার্ভিস মডিওল ‘কলাম্বিয়া’র পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। এই নভোচারীরা চাঁদের মাটিতে প্রায় ২১ ঘণ্টা ছিলেন। এসময় বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেন। অতঃপর অভিযান শেষে তারা সফলভাবে ২৪শে জুলাই নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
পৃথিবীর তুলনায় চাঁদে সবকিছুর ওজন প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। চাঁদ ভূমির উপরিভাগ পৃথিবীর মনোরম সুন্দর সৈকতের নরম বালুর কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে মাথার ওপর আমাদের মত নীল নয়, বিস্তীর্ণ হয়ে থাকবে মখমলের মত কালো আকাশ ! চাঁদের দিগন্তরেখা বক্র, যার ফলে মনে হতে পারে যেনো হাত বাড়ালেই দিগন্তরেখা ছুঁয়ে ফেলা যাবে ! আলো আর ছায়ার খেলাও এখানে অন্য রকম। বায়ুমণ্ডল না থাকায় সূর্যের আলো চাঁদকে সরাসরি আলোকিত করে। নভোচারী আর্মস্ট্রংয়ের ভাষায়, এ যেনো ‘রুক্ষতার সৌন্দর্য’।
আর অলড্রিন বলেছেন, ‘অসাধারণ এক একাকিত্ব।’
এক সাক্ষাৎকারে আর্মস্ট্রং বলেন, “অ্যাপোলো ১১ নভোযানের যাত্রা শুরুর ১ মাস আগে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, অভিযান সফল এবং চাঁদের মাটিতে নামার ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে। পৃথিবীতে ফিরে আসার ব্যাপারে আমি নিজেই ৯০ ভাগ আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু চাঁদে প্রথম চেষ্টায় অবতরণের করতে পারব কিনা তার সম্ভাবনা ধরে নিয়েছিলাম ৫০-৫০!”
চন্দ্র বিজয়ের অভিযান কি সত্যি নাকি বানোয়াট?
কিছু বিজ্ঞানী সহ একদল মানুষ ভাবেন, মানুষ নাকি আসলে চাঁদে নামতে পারেনি। তারা বিভিন্ন যুক্তি দিচ্ছেন, যার কিছু কিছু আবার বৈজ্ঞানিকভাবেও সমর্থনযোগ্য, এসব নিয়েই তারা প্রমান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন চন্দ্র অভিযান আমেরিকার ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।
অ্যাপোলো রকেট ডিজাইনের সাথে যুক্ত একজন প্রকৌশলী বিল কেইসিং তার ‘উই নেভার ওয়েন্ট টু মুন’ বইতে ১৯৭৪ সালে নানা যুক্তি দিয়ে এই অভিযানকে নাটক প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন। অ্যাপোলো মিশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ব্রাইয়ান অলেরি সহ অনেকেই তাকে সমর্থন জানান। এসব নিয়ে আর্মস্ট্রং বলেন, ‘মানুষজন মুখরোচক আর ষড়যন্ত্রের গল্প পছন্দ করে। গুজব লোকজনকে আকর্ষণ করে, কিন্তু সেসব নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার সময় নেই। কারণ আমি জানি, কোনো একদিন হয়ত কেউ আবার চাঁদে যাবেন এবং আমি যে ক্যামেরাটি সেখানে ফেলে এসেছি, সেটি উদ্ধার করে নিয়ে আসবেন গল্পকারীর জন্য। চাঁদের মাটির নমুনা আমাদের রাষ্ট্রপতি ভবনের মহাফেজখানায় (Record Room) অবশ্য রক্ষিত আছে!’
যতই বিতর্ক থাকুক, চন্দ্র অভিযান মানবজাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও, চাঁদ নিয়ে অ্যাপোলো ১১ এর সফল অভিযান আজও বড় কিছু করতে অনুপ্রেরনা যোগায়।
আরো পড়ুনঃ অ্যাপোলো ১১ মিশনের কিছু অজানা তথ্য