যান্ত্রিক সভ্যতার মাঝে টিকে থাকার কোনো একপর্যায়ে হঠাৎ করেই মনে হয় সবকিছু ছেড়ে দুরে কোথাও চলে যাই। ঘুম থেকে উঠার পর সকালের নাস্তা শেষে চা সিগারেট, প্রেম ভালোবাসা, অর্থবিত্তের সন্ধান, ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে চলা, বিয়ের পর সংসার গুছিয়ে বাচ্চাদের গড়ে তুলতে আরো সময় অবলীলায় চলে যাওয়া, এভাবে জীবনের ৩ চতুর্থাংশই চলে যায় আমাদের। তারপর আর নিজেকে সময় দেয়া হয়না। নিজের জন্য কিছু করাও হয়না। অজানা এক অপ্রাপ্তি নিয়েই চলে যেতে হয় অপারে…
Into The Wild সিনেমাটি নিয়ে লিখতে বসেছি। বাস্তব জীবনের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছে…
ক্যারিনের একমাত্র ভাই সদ্য কলেজ গ্র্যাজুয়েট ক্রিস্টোফার জনসন ম্যাকান্ডলেস অনেকদিন ধরে লাপাত্তা। তার বাবা মা তাকে খুঁজতে লোকাল পুলিশকেও খবর দিয়েছে। তবে ক্রিস্টোফার যে চলে যাবে, তা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলো ক্যারিন। অনেকদিন ধরেই এমন আভাস দিয়ে আসছিল সে। তার অভিমান ছিলো প্রথমত তার বাবা মাকে নিয়ে, পরে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ে। তাই তো ছাত্রজীবনে জমানো সব টাকা দান করে দিয়ে চলে যায় সে অজানার উদ্দেশ্যে। কোনোরকম পার্থিব বস্তু, সম্পর্কের মায়ায় নিজেকে আবদ্ধ করে না, শুধু এগোতে থাকে পথ থেকে পথে…
তার বাউন্ডুলে জীবনের কথা চারটি অধ্যায়ে ডায়েরী লিখেছিলো সে। পুনর্জন্ম থেকে পরিণত ক্রিস্টোফার ম্যাকান্ডলেস নিজের নামটা পর্যন্ত পরিবর্তন করে রেখেছিলো অ্যালেক্সান্ডার সুপারট্রাম্প (অ্যালেক্স)।
সে বিশ্বাস করত পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে অর্থ আর বিলাসের মায়া ত্যাগ করতে হবে। এসবের দরকার তৈরি করেছে এ সমাজ। অদৃশ্য ছলনায় বন্দী করে রেখেছে আমাদের। এসব থেকে আমাদের মুক্তি চাই। আর এই মুক্তি আছে শুধু প্রকৃতির মাঝে ! প্রকৃতির মাঝেই আছে বেঁচে থাকার সকল উপাদান। শুধু You have to reach out and grab it…
শন পেন এর চিত্রনাট্য আর পরিচালনায় Into the Wild সিনেমায় ক্রিস্টোফার ম্যাকান্ডলেস এর এই অ্যাডভেঞ্চারকেই তুলে ধরা হয়েছে। গল্পবলিয়ে ছিল নন-লিনিয়ার। তার শেষ গন্তব্য “ম্যাজিক বাস” থেকে একেবারে শুরুর যাত্রাপথ, পথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা হওয়া, তাদের সাথে কিছুদিন কাটানো, তাদের জীবনকে আরো কাছ থেকে দেখা, সুযোগ পেলে টুকটাক মাঠ লেভেলের কাজ শিখে নেয়া, এভাবেই সে তার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলো সুদূর আলাস্কা পৌঁছাবার…
প্রায় অসম্ভব এই মিশন চরম স্বপ্নবাদী হিপ্পিরাও সমর্থন করত না। অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো অ্যালেক্সকে। হিপ্পিরাও একসাথে বাস করে। কিন্তু অ্যালেক্স একাই যাবে। তার দরকার নেই কাউকে !
Into The Wild মুভিটা এই নিয়ে কতবার দেখেছি আর এরচেয়েও কত বেশিবার দেখার ইচ্ছা হয়েছে হিসেব নেই। অ্যাডভেঞ্চার মুভির প্রতি আমার টানটা অন্যরকম আর প্রথম যখন মুভিটা দেখেছি তখন অ্যালেক্সের চরিত্রটা দারুণ আকর্ষণ করেছিলো। তবু কখনো মনে হয়নি আসলেই এতটা করতে পারবো কিনা। করা উচিত কি উচিত না, সে নিয়ে মনের ভেতর যুদ্ধ চলে আজও। নিয়ম ভাঙ্গার মগজ জুড়ে এখন শুধুই ছক ! নির্বাসনে হারিয়ে যেতে মন চায়। তবু শেষমেশ সুপারট্রাম্পের শেষ কথাটাই মনে হয়, Happiness only when its shared…
এরকম মাস্টারপিস সিনেমা বানানোর পর কেনো শন পেন পরিচালনাটা আর চালিয়ে যাননি আমার মাথায় আসেনা। ১৪৮ মিনিটের লম্বা এ মুভিটি বায়োগ্রাফিকাল মুভি হলেও এর প্রাণ ছিলো এর মিউজিক। পার্ল জ্যাম ব্যান্ডের এডি ভেডারের সাথে মাইকেল ব্রুকের সম্মিলিত প্রয়াসে এই মুভির জন্য আলাদা গান তৈরি হয়েছিলো, যে অ্যালবাম হলিউডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা OST হিসেবে বিবেচিত হয়। সিনেমাটি যতবারই দেখা হয়, কোথাও ঘুরতে গেলে এই OST সাথে নিতে ভুল হয় না কখনো…
Into the wild এমন একটা মুভি, যেটা প্রথমবার দেখার কিছুদিন পরই আবার দেখতে ইচ্ছা করবে। যতদিন না একা এরকম কোনো জার্নি করতে পারছি। মনোযোগ না দিয়ে শুধু ছেড়ে রাখলেও চলে এর কাব্যিক ন্যারেশান স্টাইলের কারণে !
সবশেষে একটা কথা বলতেই হয়, ক্রিস্টোফার ম্যাকান্ডলেস মারা যাবার আগে খুব শোক করে বলেছিলেন, “আমি মারা যাবার পর আমার এই সুন্দর সুন্দর অ্যাডভেঞ্চারগুলো এখানেই শেষ হয়ে যাবে। কেউ জানবেও না কি হয়েছিলো আমার সাথে…”
দুঃখজনক বিষয় ছিলো এটাই, ক্রিস্টোফার ম্যাকান্ডলেস জানতেন না তিনি মারা যাবার পর গোটা দুনিয়াই তার কথা জানবে !
আর সেজন্যই বোধহয় সিনেমায় Society শিরোনামের এই গানটি যুক্ত করা হয়েছে…
“Society, you’re a crazy breed.
I hope you’re not lonely without me”