একাত্তরে ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলা দলটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে “হিট এন্ড রান” পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করেন…
ক্র্যাক প্লাটুনের নাম কিভাবে “ক্র্যাক প্লাটুন” হলো
২নং সেক্টর কমান্ডার এবং ক্রাকপ্লাটুনের মাস্টারমাইন্ড খালেদ মোশাররফ। তাঁর নির্দেশনা ছিলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে হবে। কিন্তু দুঃসাহসী এই তরুণেরা ঢাকায় এসে ৯ জুন তারিখ সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে। বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছিলো। যা ছিলো অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ ও অচিন্তনীয় কাজ।
সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, “দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল ! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে।“
তিনিই প্রথম এই দলটিকে “ক্র্যাক” আখ্যা দেন। যা থেকে পরবর্তীতে এই প্লাটুনটি “ক্র্যাক প্লাটুন” নামে পরিচিত হয়।
কিভাবে গঠন হলো ক্র্যাক প্লাটুন
এই দলটি গঠন করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো ২নং সেক্টর এর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম এবং এটিএম হায়দার বীর উত্তম। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নং সেক্টরের অধীন একটি স্বতন্ত্র গেরিলা দল ছিলো যারা আসলে গণবাহিনীর অংশ বলে পরিচিত। এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের “মেলাঘর” প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষনে গ্রেনেড ছোড়া, আত্ম-গোপন করা, অতর্কিত হামলা প্রভৃতি শেখানো হত।
ক্র্যাক প্লাটুন এর অপারেশন
ক্রাকপ্লাটুন ঢাকা শহরে ছোটো বড় মিলিয়ে মোট ৮২ টি অপারেশন পরিচালনা করে। যার বেশির ভাগই চরম দুঃসাহসী এবং অচিন্তনীয় ছিলো। তারা মূলত ৫-৬ জনের একেকটা দলে থাকতো এবং পভিযান পরিচালনা করতো। কয়েকটা অপারেশন ছাড়া তাদের প্রায় প্রতিটা অভিযানে কোনো পূর্বপরিকল্পিত প্লান থাকতো না। কয়েকটি বড় অপারেশনের নাম নিচে দেয়া হলোঃ
• অপারেশন ফ্লায়িং ফ্ল্যাগস
• অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল।
• স্টেট ব্যাংক অপারেশন।
• ডেস্টিনেশন আননোন।
• অপারেশন তোপখানা রোড ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার।
• অপারেশন গ্যানিজ পেট্রল পাম্প।
• অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন।
• অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন।
• অপারেশন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন।
• অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট।
• অপারেশন দাউদ পেট্রল পাম্প।
• অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশন।
• অ্যাটাক অন দ্য মুভ।
• টঙ্গী তিতাস গ্যাস-লাইন হামলা।
• রামপুরায় উলনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ।
ক্রাকপ্লাটুনের কয়েকজন গেরিলা
সেভাবে আসলে গেরিলাদের সবার নাম বলা সম্ভব না। এখানে সব মিলিয়ে ৮৩ জন এর নাম সংগ্রহ করতে পেরেছি। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে একাত্তরের জুনে ১৭ জন তরুণ এবং দৃঢ়চেতা মুক্তিযোদ্ধা ঢাকায় এসেছিলেনঃ
- জিয়াউদ্দিন আলী আহমেদ
- মাহবুব আহমেদ শহীদ
- শ্যামল
- আহমেদ মুনীর ভাষণ
- আনোয়ার রহমান (আনু)
- মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া
- ফতেহ আলী চৌধুরী
- আবু সায়ীদ খান
- প্রকৌশলী সিরাজ
- গাজী গোলাম দস্তগীর
- তারেক এম আর চৌধুরী
- শাহাদাৎ চৌধুরী
- রেজা
- আবদুস সামাদ
- জব্বার
- নাজিবুল হক
- ইফতেখার।
২৯ আগস্ট আটক এবং শহীদ যারা
- শহীদ শফি ইমাম রুমি, বীর বিক্রম
- শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, বীর বিক্রম
- শহীদ বাকের, বীর প্রতীক
- শহীদ আলতাফ মাহমুদ
- শহীদ বদিউল আলম বদী, বীরবিক্রম
- শহীদ সেকান্দর হায়াত
- শহীদ হাফিজ
- শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ
- শহীদ আবদুল্লাহও-হেল-বাকী
ক্রাক প্লাটুনের অন্যান্য গেরিলারা
- মোমিনুল হাসান
- প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম
- আবুল বারেক আলভী
- জহিরুল ইসলাম
- জহির উদ্দিন জালাল
- মাযহার
- লিনু বিল্লাহ
- হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক
- শাহাদাৎ চৌধুরী, (শাঃচৌঃ নামে পরিচিত)
- মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম
- জিয়াউদ্দিন আলী আহমদ
- কাজি কামাল উদ্দিন, বীর বিক্রম
- কামরুল হক স্বপন, বীর বিক্রম
- ফতেহ আলী চৌধুরী
- মাসুদ সাদেক চুল্লু
- ইশতিয়াক আজিজ উলফাত
- সাদেক হোসেন খোকা
- আব্দুস সামাদ, বীর প্রতীক
- তৈয়ব আলী, বীর প্রতীক
- আবু সাইয়িদ খান
- গাজি গোলাম দস্তগির
- খালেদ আহমেদ
- মোঃ হানিফ
- নিলু– ১
- নিলু- ২
- আহমেদ মুনির ভাষণ
- শ্যামল
- নাজিবুল হক
- রুপু
- শহীদুলাহ খান বাদল
- রেজা
- জব্বার
- ইফতেখার
- প্রকৌশলী সিরাজ ভুঁইয়া
- ডঃ তারেক মাহফুজ
- মুজিবর রহমান
- পুলু
- কুলুরশিদ (কমলাপুরের কুলি সর্দার)
- শহীদ
- অপু
- এমএ খান (‘ম্যাক’ নামে পরিচিত ছিলেন)
- ফাজলি
- মোস্তফা কামাল বকুল
- এএফএমএ হ্যারিস
- হিউবার্ট রোজারিও
- আবুল ফজল সিদ্দিক মনু
- আকরাম হোসেন মল্লিক ভুলু
- ইশতিয়াক আজিজ
- আতিক
- ওয়াসেফ
- আনোয়ার রহমান আনু
- মেসবাহ জাগিরদার
- মোক্তার (তাঁতি)
- জিন্নাহ
- শরিফ
- নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু
- আজম খান
দ্বিতীয় পর্যায়, একাত্তরের সেপ্টেম্বরে আবার ক্রাকপ্লাটুন সক্রিয় করা হয়েছিলো।
একাত্তরে ক্রাকপ্লাটুন অনেকের কাছে বিচ্ছু হিসেবে পরিচিত ছিলো। তাঁরা হুট করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে হামলা যাকে বলে এসে অতর্কিত হামলা করে খুব তাড়াতাড়ি গায়েব হয়ে গা ঢাকা দিতো। তাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে ক্রাকপ্লাটুন একটি ভীতির নাম ছিলো। তাই তাদের যেকজনকে ধরতে পেরেছিলো তাদের কদিন পর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
বিনম্র শ্রদ্ধা তাদের প্রতি…