দেশের সমাজ আমাদের স্বপ্ন বড় করা শিখায় ঠিক কতদুর এবং আমাদের ঠিক কতটুকু সুযোগ দেয় নিজেকে বড় হবার সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি চিন্তা ভাবনার দরকার হয়না। পাশের দেশ ভারত যাদের সমাজ আর আমাদের সমাজ একই গোড়া থেকে উঠে আসা তাই পার্থক্য এর উদাহরণ টা তাদের দিয়েই দেয়া খুব সম্ভত ভালো হবে।
অনেক দিন আগে একটা আর্টিকেল এ পড়েছিলাম। সেখানে একটা লাইন ছিলো এমন “ইন্ডিয়া একটি দেশ যা কিনা সিইও উৎপাদন করে। কয়েকটা উদাহরণ দেই –
- সুন্দর পিচাই, সিইও, Google
- সত্য নাদেলা, সিইও, Microsoft
- শান্তনু নারায়েন, সিইও, Adobe
- ফ্রানসিস্কো ডি’সুজা, সিইও, Cognizant
- রাজিব সুরী, সিইও, Nokia
- সঞ্জয় কুমার ঝা, সিইও, Globalfoundries
- দিনেশ পালিওয়াল, চেয়ারম্যান এবং সিইও, Harman International
- জর্জ কুরিয়েন, সিইও, NetApp
- ইন্দ্রা নুই, চেয়ারপার্সন এবং সিইও, PepsiCo
- অজয় বানগা, প্রেসিডেন্ট এবং সিইও, MasterCard
- পীযুষ গুপ্ত, সিইও, DBS Group
- ইভান ম্যানুয়েল মেনেজেস, সিইও, Diageo
- রাকেশ কাপুর, সিইও, Reckitt Benckiser
- সঞ্জয় মেহরোত্রা, সিইও, SanDisk …ইত্যাদি !
এছাড়াও বিশ্বের অনেক কোম্পানির সিইও ভারতীয়। লিস্ট বড় করলে বড় হতেই থাকবে। এমনকি আমাদের দেশের অনেক বড় কোম্পানির সিইও ভারতীয়। কোম্পানিগুলোকে নতুন করে পরিচিত করবার কিছুই নেই। তারপরও অপরিচিত থাকলে টুক করে উইকিপিডিয়াতে গিয়ে দেখে নিন, একেকটা ঠিক কত বড় কোম্পানি !
মজার কথা হচ্ছে, এইসব ভারতীয়দের মধ্যে হাতে গোনা দুই একজন বাদে সবারই গ্রাজুয়েশন ভারতের নানান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানে তারা নিজেদের দেশে বড় হয়ে এসব কোম্পানির বড় পদে আসীন। আর আমাদের দেশের কিছু উদ্ভাবক থাকলেও তাঁর ৯৫ ভাগ হয় জন্ম বিদেশে, সেখানেই বড় হওয়া অথবা ছোটোবেলা থেকে বিদেশে থাকে এমন।
যখন তারা এরকমভাবে বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ঠিক তখন আমরা ভাবছি কিভাবে বিসিএস ক্যাডার হওয়া যায় কিংবা সরকারী একটা ব্যাংকে চাকুরী বা একটা পেপার নকল করা পিএইচডি ডিগ্রি। ব্যস আর কি চাই। ব্যাংক কয়দিন পর লোন দিবে। একটা বাড়ি বানাবো। রিটায়ারে বেশ একটা বড় টাকা পাবো এবং এসব শুনলে খুব একটা ভাব নিয়ে বলবো, “আরে ওরা যাই করুক, ওদের তো টয়লেটই নাই।“
আমাদের দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় একেকটা গ্রাজুয়েট বানানোর কারখানা মাত্র। এর বাইরে কিছুই না।
ঠিক সে মুহূর্তে তারা মগ্ন অন্য কিছুতে।
Samsung Galaxy Gear এর নাম শুনেছেন অবশ্যই। Smart Watch, সেটার উদ্ভাবক এবং হেড অফ টিম প্রনব মিস্ত্রী, ভারতীয়। তাঁর গ্রাজুয়েশন ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া নাম না জানা নির্মা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন ভাবুন তাদের নাম না জানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা।
সত্যি বলতে যেখানে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর প্রশ্ন ফাঁস হয়, সেখানে এই কথাগুলো অর্থহীন।
ঠিক সে মুহূর্তে বাংলাদেশের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া বন্ধু জানায় ওদের থিসিস করার জন্য ভার্সিটি থেকে পাবে মাত্র আড়াই হাজার টাকা। কিভাবে কি করবে সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত।
বলিউডে শাহরুখ খানের একটা চলচ্চিত্র আছে, নাম Swades ! সেখানে একটা কথোপকথন আছে এমন, ও অনেকদিন পর দেশে আসে আমেরিকা থেকে। গ্রামের লোকজন বলে, আমাদের ভারতবর্ষ সেরা। তখন শাহরুখ খান বলে ওঠে, ‘আমি মনে করিনা আমাদের দেশ সেরা। তবে হা আমাদের দেশ সেরা হবার জন্য যা যা উপাদান দরকার সবই আছে।’
ব্যাপারটা ঠিক তেমনই সঠিক আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। আমি আসলেই মনে করি না আমাদের দেশ সেরা। তবে সেরা হবার জন্য সকল উপাদান এদেশে বিদ্যমান। খুঁজে কাজে লাগানোর অপেক্ষামাত্র। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা কাজে লাগানোর সময় করে উঠতে পারি না। এমনকি চেষ্টা বা ইচ্ছা শক্তিও নেই।
আমরা ক্রিকেটে শুধু ভারতকে হারালেই দেশ প্রেম জেগে ওঠে এবং মনে হয়, হ্যাঁ আমাদের দেশ সেরা। সেটা বলে রাতে আরামে ঘুমাতে যাই।
কিন্তু আপনি জানেন কি ভারত ১০৪ টা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে একবারের চেষ্টায় যেটা কিনা বিশ্বরেকর্ড।
ভারতে ইউরেনিয়াম সহজলভ্য নয়। কিন্তু থোরিয়াম সহজলভ্য এবং বিশ্বের দ্বিতীয় থোরিয়াম সাপ্লায়ার। তার উপর ইউরেনিয়াম এর রিএক্টরে ১০০ ভাগের ১ ভাগ শক্তিতে রূপান্তর করা যায়, বাকিটা আবর্জনা। তো তাদের সায়েন্টিস্টরা করলো কি, ভারতে সহজলভ্য হচ্ছে থোরিয়াম, তাই তারা থোরিয়াম দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায় এমন রিএক্টর বানালো। যার প্রায় ১০০ ভাগই শক্তিতে পরিণত করা সম্ভব এবং রিয়েক্টর কম ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের রিসার্চ এ সময় লেগেছে ২৭ বছর। তাদের আগে একমাত্র রাশিয়া এমন রিয়েক্টর বানাতে সফল হয়েছে। এখনও রিসার্চ এ সফলতার মুখ দেখেনি জাপান এবং জার্মানি। তাছাড়া ভারতের মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, যা কিনা আবার একবারের প্রচেষ্টায়। একবারের প্রচেষ্টায় এর আগে সফল হয়নি কোনো দেশ !
এখানেই ওই কথোপকথনটার কথা ফলে। আসলে আমাদের খুঁজতে হবে বিকল্প কি !
বিকল্প কি?
আমাদের দেশের সহজলভ্য হচ্ছে কয়লা। একবার কোনো একটা প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, দেশে যা কয়লা এখন আমাদের আছে, তাতে কয়লা শূন্য হতে বেশি বাকি নেই। নেই তো বিকল্প কি দিয়ে সম্ভব, সেটা কি কেউ চিন্তা করেছে?
হ্যাঁ করেছে। কি জানেন? সুন্দরবনের ১৫ কিমি এর মধ্যে একটা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র। সেটার পক্ষে আবার মানুষকে যখন আবার বলতে শুনি তখন ভালো বোধ হয়না।
ভারতকে উদাহরন হিসেবে বার বার টানার কারন, আপনারা নিজেদের মধ্যে চিন্তা লালন করেন “যাই হোক ভারত হারলেই আমরা জিতে যেই।” যেমন ঠিক এখনই বলে উঠবেন ভারতের স্যানিটেশন সমস্যা আছে, টয়লেট নেই বলে হো হো হেসে উঠবেন।
তবে আপনি জানেন কি, ভারতে যেমন প্রায় ৮০ কোটি লোক স্যানিটেশন সুবিধার বাইরে, চীনেও কিন্তু সংখ্যাটা প্রায় ৬০ কোটির আশেপাশে। আর আমাদের দেশে সেটা ৬ কোটি। মানে ১৭ কোটির মধ্যে ৬ কোটি মানুষ স্যানিটেশনের বাইরে।
এখন আসা যাক খেলাধুলার কথায়। খেলাধুলার কথা বললে আবার ভালো লাগে কিনা। একসময় ফুটবলের র্যাংকিং এ দেখেছিলাম বাংলাদেশ ১৪৬ এবং ভারত ১৫৭। যা খুব আগের কথা না। এই ৫ থেকে ৬ বছর হবে। এখন বাংলাদেশ এর অবস্থান ১৯০। যেখানে মোট র্যাংকিং সংখ্যা ২০৬। আর ভারতের র্যাংক কত জানেন? সংখ্যাটা হচ্ছে ৯৬ !
স্বপ্ন দেখা যেমন আমাদের দ্বায়িত্ব, সেটাকে পূরণ করার সুযোগ তৈরী করে দেয়ার দ্বায়িত্বটা সবার। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা তো এখানেই !