মহানবী (সাঃ) -এর মেয়ে ছিলেন চারজন। তারা প্রত্যেকেই ইসলাম কবুল করেন। সবাই বয়োপ্রাপ্ত হন এবং বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেন। প্রথম ও চতুর্থ মেয়ের একটিই বিয়ে হয়। মাঝের দুজনের বিয়ে হয় দুইবার। সংক্ষেপে মহানবী (সাঃ) এর জামাতারা হলেন –
১. আবুল আস বিন রবি (রাঃ) নবুয়ত-পূর্বকালে মহানবী (সাঃ) এর বড় মেয়ে জয়নব (রাঃ) এর বিয়ে হয় আপন খালাতো ভাই আবুল আস বিন রবির সঙ্গে। হিজরতকালে রাসূল (সাঃ) স্বীয় পরিবার-পরিজনকে মক্কাতেই রেখে যান। কিন্তু বদর যুদ্ধে আবুল আস বন্দি হয়ে মদিনায় নীত হয়। তার মুক্তি প্রদানের সময় এ অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিল যে, তিনি মক্কা প্রত্যাবর্তন করে জয়নবকে মদিনায় পাঠিয়ে দেবেন। অঙ্গীকার মতো আবুল আস মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে ভাই কেনানার সঙ্গে হজরত জয়নবকে মদিনায় রওনা করে দিলেন। অপরদিকে রাসূল (সাঃ) আদরের দুলালি জয়নবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জায়েদ বিন হারেছাকে মক্কা অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। পথে জায়েদের সঙ্গে কেনানার দেখা হয়। কেনানা জয়নবকে জায়েদের কাছে তুলে দিয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। এভাবে জয়নব রাসূল (সাঃ) এর কাছে পৌঁছে যান। হজরত জয়নবের স্বামী আবুল আস বিন রবি ছিলেন মোশরেক। কিন্তু জয়নব ছিলেন ঈমানদার। তাই আবুল আসকে ছেড়ে আসতে জয়নব বাধ্য হয়েছিলেন। শাম থেকে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে প্রত্যাবর্তনকালে তিনি আবার মুসলিম বাহিনীর অভিযানে দ্বিতীয়বার আটক হয়ে মদিনায় নীত হন। এবারও জয়নব তাকে মুক্তি লাভের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন। ফলে তার মনের পরিবর্তন ঘটে। তিনি মক্কা গমন করে যাবতীয় লেনদেন শোধ করেন এবং সব আমানত হকদারদের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে ইসলাম কবুল করে মদিনায় চলে আসেন। এবার তিনি ইসলাম কবুল করায় তার এবং জয়নবের নতুন করে বিয়ে পড়ানো হয়। আবু বকর (রাঃ) এর খেলাফতকালে ১২ হিজরির জিলহজ মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইবনে হাজর, ইসাবা : ৭/২৫১)
২. উতবা ও উতাইবা বিন আবু লাহাব রাসূল (সাঃ) এর দ্বিতীয় মেয়ে রুকাইয়ার প্রথম বিয়ে হয় আবু লাহাবের এক ছেলে উতবা ইবনে আবু লাহাবের সঙ্গে এবং আরেক মেয়ে উম্মে কুলসুমের শাদি হয় আবু লাহাবের দ্বিতীয় ছেলে উতাইবার সঙ্গে। বিয়ের পর ঘর-সংসার হওয়ার আগেই পবিত্র কোরআনের সূরা লাহাব নাজিল হয়। আবু লাহাব ছিল আল্লাহর নবীর ঘোর শত্রু। সূরা লাহাবে আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিলের (হাম্মা লাতাল হাতাব) সমালোচনা করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে আবু লাহাব ছেলেদের নির্দেশ দেয় দুই নবী তনয়াকে তালাক দিতে। পিতার নির্দেশ মাফিক তারা তাদের তালাক দিয়ে দেয়।
৩. ওসমান বিন আফফান (রাঃ) উতবা বিন আবু লাহাবের সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদের পর রুকাইয়ার বিয়ে হয় ওসমান বিন আফফান (রাঃ) এর সঙ্গে। তার জন্ম হস্তীবাহিনীর ঘটনার ছয় বছর পর ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে। ওসমান (রাঃ) ছিলেন কোরাইশ বংশের অন্যতম কুষ্ঠিবিদ্যা বিশারদ। কোরাইশদের প্রাচীন ইতিহাসেও ছিল তার গভীর জ্ঞান। তার প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, সৌজন্য ও মানবিকতাবোধ ইত্যাদি গুণাবলির জন্য সবসময় তার পাশে মানুষের ভিড় জমে থাকত। জাহেলি যুগের কোনো অপকর্ম তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। লজ্জা ও প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তার মহান চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যৌবনে তিনি অন্যান্য অভিজাত কোরাইশদের মতো ব্যবসা শুরু করেন। সীমাহীন সততা ও বিশ্বস্ততার গুণে ব্যবসায় অসাধারণ সাফল্য লাভ করেন। মক্কার সমাজে একজন বিশিষ্ট ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে ‘গনি’ উপাধি লাভ করেন। মক্কার আরও অনেক নেতার আচরণের বিপরীতে হজরত ওসমান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নবুয়তের সূচনা-পর্বেই তার দাওয়াতে সাড়া দেন এবং আজীবন জানমাল ও সহায়সম্পত্তি দিয়ে মুসলমানদের কল্যাণব্রতী ছিলেন। হজরত ওসমান (রাঃ) বলেন, আমিই ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম চারজনের মধ্যে চতুর্থ। ইবনে ইসহাকের মতে, আবু বকর, আলী, জায়িদ বিন হারেসার পরে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি হজরত ওসমান (রাঃ)। হিজরি দ্বিতীয় সনে মদিনায় রুকাইয়ার ইন্তেকাল হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার দ্বিতীয় মেয়ে উম্মে কুলসুমকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন তৃতীয় হিজরিতে। দীর্ঘদিন নিজ আবাসে অবরুদ্ধ থাকার পর ৩৫ হিজরির ১৮ জিলহজ শুক্রবার বাদ আসর ইসলামের এ তৃতীয় খলিফা দুষ্কৃতকারীদের হামলায় শহীদ হন। জান্নাতুল বাকির ‘হাশমে কাওয়াব’ নামক অংশে তাকে দাফন করা হয়।
৪. আলী বিন আবু তালেব (রাঃ) অপরিসীম গুণের আধার ফাতেমা (রাঃ) পূর্ণ বয়সে উপনীত হলে বহু স্বনামধন্য সাহাবি বিয়ের প্রস্তব দেন। অবশেষে মহানবী (সাঃ) এর চাচাতো ভাই হজরত আলীর সঙ্গে দ্বিতীয় হিজরিতে আদরের মেয়ের বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির ১০ বছর আগে আলী (রাঃ) এর জন্ম। চাচাকে একটু সাহায্য করার উদ্দেশ্যে রাসূল (সাঃ) নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন আলীকে। এভাবে নবী পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে তিনি বেড়ে ওঠেন। রাসূল (সাঃ) যখন নবুয়ত লাভ করেন, আলীর বয়স তখন নয় থেকে এগারো বছরের মধ্যে। কুফর, শিরক ও জাহেলিয়াতের কোনো অপকর্ম তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মহিলাদের মধ্যে হজরত খাদিজা, বয়স্ক আজাদ পুরুষদের মধ্যে হজরত আবু বকর, দাসদের মধ্যে হজরত জায়েদ বিন হারেসা ও কিশোরদের মধ্যে আলী (রাঃ) প্রথম মুসলমান। মাদানি জীবনের সূচনায় রাসূল (সাঃ) যখন মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে মোয়াখাত বা দ্বীনি ভ্রাতৃ-সম্পর্ক কায়েম করেছিলেন, তিনি নিজের একটি হাত আলীর (রাঃ) কাঁধে রেখে বলেছিলেন, আলী তুমি আমার ভাই। তুমি হবে আমার এবং আমি হব তোমার উত্তরাধিকারী। পরে রাসূল (সাঃ) আলী ও সাহল বিন হুনাইফের মধ্যে ভ্রাতৃ-সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন। ইসলামের জন্য হজরত আলী (রাঃ) এর অবদান অবিস্মরণীয়। রাসূলে করিম (সাঃ) এর যুগের সব যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় তিনি দেন। এ কারণে হুজুর (সাঃ) তাকে হায়দার উপাধিসহ জুলফিকার নামক একখানি তরবারি দান করেন। সপ্তম হিজরিতে তার হাতে খাইবার যুদ্ধ বিজয়ের ঘটনা পৃথিবীর যুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীরত্বের ঘটনা। তাবুক অভিযানে বের হওয়ার সময় মহানবী (সাঃ) তাকে মদিনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওফাতের পর তাঁর নিকটাত্মীয়রাই কাফন-দাফনের দায়িত্ব পালন করেন। হজরত আলী (রাঃ) গোসল দেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। বিদ্রোহীদের দ্বারা হজরত ওসমান ঘেরাও হলে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে হজরত আলীই (রাঃ) সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেন। সেই ঘেরাও অবস্থায় হজরত ওসমানের বাড়ির নিরাপত্তার জন্য তিনি তার দুই ছেলে হাসান ও হোসাইন (রাঃ) কে নিয়োগ করেন। ৪০ হিজরির ১৬ রমজান শুক্রবার দিবাগত রাতের ঘটনা। ফজরের সময় ইসলামের এ চতুর্থ খলিফা আলী (রাঃ) অভ্যাসমত আস-সালাত বলে মানুষকে নামাজের জন্য ডাকতে ডাকতে যখন মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, পাপাত্মা ইবনে মুলজিম শানিত তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আহত করে। চার বছর নয় মাস খেলাফত পরিচালনার পর ১৭ রমজান ৪০ হিজরি শনিবার কুফায় তিনি শাহাদতবরণ করেন। কুফা জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে, নাজফে আশরাফে তাকে সমাহিত করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।