স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ যে কয়টি ক্ষেত্রে খুব দ্রুত উন্নত ও আধুনিক হয়েছিলো, তারমধ্যে টিভি নাটক অন্যতম। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তৎকালীন সময়ের বেশ কয়েকজন শক্তিমান অভিনেতা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন সৃষ্টিশীল অভিনেতা হচ্ছেন আবুল হায়াত ! যিনি সেই সত্তর দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তার অভিনয়ের জাদু দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছেন।
বর্তমান জেনারেশনের অনেকেই হয়ত জানেনা যে, টেকো মাথার এই লোকটার একসময় মাথাভর্তি চুল ছিলো। সে যুগের মেয়েদের হার্টথ্রব তারকা ছিলেন আবুল হায়াত। তার নাকের নিচের গোঁফ ছিলো সেই সময়কার যুবকদের আইকনিক স্টাইল।
আবুল হায়াতের ছেলেবেলা
সময়টা ১৯৪৭, লর্ড মাউন্টব্যাটনের ছক অনুযায়ী দেশ ভাগ করা হবে। ওপার বাংলার মুর্শিদাবাদের আদিনিবাস ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে পাড়ি জমান জনাব আব্দুস সালাম। সাথে স্ত্রী আর তিন বছরের ছোট্ট ছেলে আবুল হায়াত।
সেই থেকে চট্টগ্রামের মাটিতে বেড়ে ওঠা আবুল হায়াতের। শৈশব, কৈশর এবং যৌবনের খানিকটা তার এখানেই কাটে। আব্দুস সালাম সাহেবের ছিলো মঞ্চ নাটকের নেশা। কোথাও নাটকের আসরের খোঁজ পেলেই ছুটে যেতেন সেখানে, সাথে সঙ্গী হিসেবে থাকত কিশোর আবুল। এভাবে বাবার সাথে নাটক দেখতে দেখতে খুব অল্প বয়সেই নিজের মধ্যে নাটকের প্রতি আগ্রহ আর অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেন আবুল হায়াত। ফলশ্রুতিতে মাত্র ১০ বছর বয়সেই প্রথম মঞ্চে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান তিনি। তার অংশগ্রহণে প্রথম নাটক ছিলো “টিপু সুলতান”।
অভিনয় ক্যারিয়ার
১৯৬৮ সালের কথা, সবেমাত্র বুয়েট থেকে পাশ করে বের হয়েছেন তিনি। ঢাকায় মেসে থাকতেন। এসময় তিনি জানতে পারেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় গ্রুপ থিয়েটারের একটি নাটক তৈরী হবে, যা টেলিভিশনে দেখানো হবে। আমেরিকা থেকে নাট্য নির্মাণের উপর মাস্টার্স করে আসা জিয়া হায়দার সেই নাটকের নির্দেশনা দিবেন। নাটকের নাম ইডিপাস। এই ইডিপাসের মাধ্যমেই টেলিভিশনে নাটকের যাত্রা শুরু করেন আবুল হায়াত। সেই থেকে আজ অব্দি প্রায় হাজারখানেক নাটকে নিজের অভিনয় প্রতিভার নিদর্শন দেখিয়েছেন এই গুণী অভিনেতা।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি খুব বেশী মনযোগ দেননি আবুল হায়াত। ১৯৭২ সালে সুভাস দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে আগমন করেন। প্রয়াত অভিনেতা সালমান শাহ’র প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এ বড় মির্জা চরিত্রে অভিনয় করেন আবুল হায়াত। এরপর অল্প কিছু ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন তিনি। এরমধ্যে ডিপজল সহ আরেক প্রয়াত অভিনেতা চিত্রনায়ক মান্নার সাথেও একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০০৭ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও ১৯৯৯ এবং ২০১১ সালে তিনি মেরিল প্রথম অালো পুরষ্কার অর্জন করেন।
লেখক আবুল হায়াত
অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখির কাজেও দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন আবুল হায়াত। প্রথম আলো পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি, নাম ‘এসো নীপবনে’। ১৯৯১ সালের বইমেলায় তার প্রথম বই ‘আপ্লুত মরু’ প্রকাশিত হয়।
এরপর একে একে লিখেছেন নির্ঝর সন্নিকটে, এসো নীপবনে (তিন খন্ড), জীবন খাতার ফুটনোট (২ পর্ব), অচেনা তারা, হাঁসুলি বেগমের উপকথা, মধ্যাহ্নভোজ কি হবে?, এবং জিম্মি। বইগুলো সমসাময়িক সময়ের পাঠক সমাজে বেশ আলোচিত হয়েছিলো।
ব্যক্তিগত জীবনে আবুল হায়াত
লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী আবুলের স্কুল জীবন কাটে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট ও রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন (বর্তমান এসএসসি) পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ১৯৬২ সালে ভর্তি হন বুয়েটে। বুয়েটে পড়ার সময় তিনি শেরেবাংলা হলে থাকতেন। এরপর বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে ১৯৬৭ সালে পাস করে পরের বছরেই ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী পদে চাকুরী জীবন শুরু করেন। প্রকৌশলী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও তার মূল আকর্ষণ ছিল অভিনয়ের প্রতি।
১৯৭০ সালে আবুল হায়াত বিয়ে করেন তার মেজো বোনের ননদ নাম মাহফুজা খাতুন শিরিন কে। এরপর ১৯৭১ আবুল হায়াত যুদ্ধের দুদিন আগে গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি হসপিটালের বেডে অচেতন অবস্থায় পরে থাকাকালীন সময়ে যুদ্ধের গোলাগুলি আর বারুদের বিস্ফোরণের মাঝেই জন্ম নেয় তাঁর প্রথম সন্তান বিপাশা হায়াত ! এই বিপাশাও এক সময় জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বিপাশার জন্মের প্রায় ৬ বছর পর আবুল হায়াত-শিরিন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান নাতাশা হায়াতের জন্ম হয়। বিখ্যাত অভিনেতা তৌকির আহমেদ এবং অভিনেতা-মডেল তারকা শাহেদ শরীফ খান হচ্ছেন আবুল হায়াতের দুই জামাতা।
১৯৭৮ সালে তাকে কর্মসূত্রে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। বছর তিনেক পর আবুল দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৮২ সালে সরকারী চাকুরী থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি কনসালটেন্ট হিসেবে চাকরী করা শুরু করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বেশ হাসিখুশি, নিরহংকারী এবং মিশুক একজন ব্যক্তি আবুল হায়াত। সহজেই যে কারো সাথে মিশে যেতে পারেন। পছন্দ করেন বাচ্চাদের সঙ্গ। অবসরের পুরো সময়টাই তিনি তাঁর পরিবারকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কখনোই কোনো ঝামেলায় যান না। তীব্র দানশীল একজন মানুষ এই আবুল হায়াত। তাই ‘মিডিয়ার ভদ্রলোক’ বলেই ডাকা হয় তাঁকে !
আবুল হায়াত এমন একজন ব্যক্তি, তাঁকে নিয়ে লিখতে শুরু করলে লেখা শেষ হবেনা। তিনি এমন একজন মানুষ, যাকে নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নাই, শুধু রয়েছে শ্রদ্ধা, সম্মান এবং অশেষ ভালোবাসা। আবুল হায়াতের মত অভিনেতারা সহস্র বছরে একবারই আসে। আর অভিনয় গুণে মন জয় করে নেয় লাখো কোটি দর্শকদের !
ছারপোকা পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা এই গুণী অভিনেতার দীর্ঘায়ু কামনা করছি…
আরো পড়ুনঃ