মানসিক রোগ মানেই শুধু পাগলামি নয়। নানান রকমের প্রকারভেদ রয়েছে মানসিক রোগসমূহের। আবার এরমাঝেও রয়েছে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী ভিন্নতা। অদ্ভুত এসব মানসিক রোগ নিয়েই আমাদের এই পোস্ট ! আজকে প্রথম পর্বটি প্রকাশ করা হলো। বাকিগুলোও আসছে শীঘ্রই !
চলুন জেনে নেয়া যাক অদ্ভুত সব মানসিক রোগ সমূহের নাম ও সংজ্ঞা –
হাইব্রিস্টোফিলিয়া (Hybristophilia)
উদ্ভট ধরনের এই শব্দটি একটি মানসিক রোগের নাম। এটি কোনো রেয়ার রোগ নয়। তবে বাংলাদেশে অনেকের জানা নেই এবং মানসিক রোগ নিয়ে অতটা মাথা ঘামাই না বলেই শব্দটা নতুন। যদিও এই রোগটি মেয়েদের মইদ্ধে বেশি দেখা যায় তবে সবার মধ্যেই দেখা যেতে পারে।
সোজা কথায় যদি এর সংজ্ঞা দিতে হয়, তাহলে এভাবে দেয়া যেতে পারে, “ভয়ংকর আসামী কিংবা অপরাধী কিংবা নেগেটিভ কর্মকান্ড এ জড়িত দের প্রতি মানসিক কিংবা শারিরিকভাবে প্রচন্ড রকম আকর্ষণ অনুভব করা।”
উদাহরণ স্বরুপ, আমাদের বিদেশের দিকে নজর দিতে হবে না। গতবছরের হলি আর্টিজান ট্রাজেডির দিকে তাকালেই হবে। অপরাধীদের প্রতি অনেকেই সমবেদনা জানে ‘ছেলেটা কি কিউট‘ এরুপ মন্তব্য করেছে। সেটাকে অনেকেই মজা বলে উড়িয়ে দিলেও এটা কিন্তু বেশ ভাবনার বিষয়। কারণ এটা হাইব্রিস্টোফিলিয়ার একটা টার্ম Passive এর অন্তর্ভুক্ত।
হাইব্রিস্টোফিলিয়া দুই ধরনের, Passive এবং Aggressive !
- Passive: কারো প্রতি এদের আসক্তি প্রবল হয়না। এরা কাউকে পছন্দ করলে অনেকগুলো প্রেমপত্র পাঠিয়ে বা প্রেমের প্রস্তাব জানিয়েই কিছুক্ষণ পর সরে আসে। সাময়িক এই আসক্তিটা তাদের ভেতর সাধারণত করুণা, সমবেদনা থেকে আসে।
- Aggressive: এই টার্মে শুধুমাত্র আসক্তি নয়, বরং নির্দিষ্ট একটি অপরাধে জড়িত অপরাধীর প্রতি প্রবল আসক্তি আসে।
আমরা মাঝে মাঝেই এটা দেখে অবাক হই, একটা জঘন্যতম খারাপ লোকের চরিত্র সম্পর্কে সব জানা স্বত্বেও এদের সাথে কেউ প্রেম করছে বা সম্পর্ক গড়ছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এটাকে প্রেম বলা হলেও এগুলোর বেশিরভাগই এই হাইব্রিস্টোফিলিয়া’র টার্ম। কখনো অল্প আর কখনোবা বেশি, এটুকুই শুধু পার্থক্য…
মিথোম্যানিয়া (Mythomania)
অদ্ভুত মানসিক রোগ সমূহের মধ্যে এটি অন্যতম। এই রোগটি যাদের আছে, তারা অকারণেই মিথ্যে বলে। যেখানে কোনো কথা বলারই প্রয়োজন নেই, সেখানেও আক্রান্তরা একটি মিথ্যা বলে আসে। এরকম মিথ্যে বলা একটি মানসিক রোগ। যার নাম Mythomania ! একে “Pseudologia Fantastica” ও বলা হয়ে থাকে।
নারীরা খানিকটা রাগ হলেও একথা সত্য যে, এই রোগ পুরুষদের চেয়ে নারীদের মাঝেই বেশি দেখা যায়।
এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের বলা মিথ্যা আর সাধারণ মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, যারা এই রোগে আক্রান্ত, তারা কোনো কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলে এবং সেই মিথ্যাটাকে সে সত্য হিসেবে বিবেচনা করেই মিথ্যা বলে। সোজা কথায়, তার কাছে এটা কোনো মিথ্যে নয়। তার কাছে মিথ্যে ব্যাপারটাই একটা সত্য ঘটনা। এবং তারা সত্যটাই বলছে, এমনটাই তারা ভাবে।
মাঝে মাঝে এটি এমন প্রকট হতে পারে যে তারা তাদের মিথ্যেটা সাজানোর জন্য মিথ্যে কাল্পনিক চরিত্র পর্যন্ত বানিয়ে ফেলতে পারে। তারা এই মিথ্যে জগত বানিয়ে তার মধ্যে নিজেকে আটকেও রাখতে পারে। সেটা পজেটিভ আটকে রাখা নয়।
মিথোম্যানিয়া রোগের চিকিৎসাও বেশ কঠিন। কারণ মিথোম্যানিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা তাদের বলা মিথ্যাগুলোকে মিথ্যা বলে ভাবেই না। তাই তারা এর চিকিৎসার দিকেও ঝুঁকে না।
বিবলিওম্যানিয়া (Bibliomania)
অদ্ভুত মানসিক রোগগুলোর মধ্যে ‘বিবলিওম্যানিয়া’ একটু অন্যরকম অদ্ভুত। এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের বই সংগ্রহের প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষণ দেখা যায়। একরকম অবসেশন বলতে পারেন। জন ফেরিয়ার (John Ferrier) নামে এক ফিজিশিয়ান ১৭’শ শতকে সর্বপ্রথম সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার এর এই টার্মটি সম্পর্কে প্রথম বর্ণনা করেন। তার এক বন্ধু এটা নিয়ে গবেষণা করে এই টার্মটি বর্ণনা করেন।
কিন্তু আপনাদের কাছে মনে হতে পারে যে, বই সংগ্রহ তো খারাপ কিছু নয়। রোগটি তো তাহলে ভালোই। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক বই কিনলেও সে বই তেমন একটা পড়ে না। এবং শুধু তাইই নয়। সে একই বইয়ের অনেক কপি কিনে ফেলে এবং ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মুদ্রণও কিনে থাকে।
আবার কিছু মানুষ বই পড়লেও, এদের মধ্যে আবার অনেককে নিজের সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করেও বই কিনতে দেখা গেছে। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকে বই কেনার জন্য চুরি ডাকাতি পর্যন্তও করেছে।
স্টিফেন ব্লুমবার্গ নামে এক আমেরিকান ভদ্রলোক ২৩ হাজার ৬’শ বই চুরি করে সংগ্রহ করেছিলো, যার মূল্য ছিলো প্রায় ৫.৩ মিলিয়ন ডলার। তাকে ১৯৯০ সালে এরেস্ট করা হয়। তখন তার কাছে এসব বই পাওয়া যায়।
স্যার থমাস ফিলিপস, তার সংগ্রহে ছিলো ১ লাখ ৬০ হাজার বই। যা কিনা তার মারা যাবার ১০০ বছর পর এসেও নিলামে বিক্রি হচ্ছে।
বইয়ের প্রতি আগ্রহ কখনোই খারাপ না, তবে যখন তা সীমা ছাড়িয়ে যায়, এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, তখন সেটা মানসিক রোগের পর্যায় পরে।
ডোরোম্যানিয়া (Doromania)
এই মানসিক রোগটা যার হয়, তার আশেপাশের মানুষেরা বড্ড লাভবান হয়। ব্যাপারটা মজার হলেও ঠিক অতটা সহজ নয়।
ভাবুন তো আপনি প্রতিদিন বা প্রায়শই একজনের কাছ থেকে অকারণে উপহার পেয়ে যাচ্ছেন। তা যেমন কমদামী, সস্তা উপহার, আবার তেমনি দামী উপহার। আপনি তখন অবশ্যই খুব অবাক হবেন। কে উপহার দিলো, কেনো উপহার দিলো? ভালোভাবে ভেবে দেখলেন, উপহার পাবার মত কোনো কারণ নেই। একটু খোঁজ নিয়ে দেখলেন এরকম আরো কয়েকজনকে সে এভাবেই বিনা কারণে উপহার দিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা তখন আপনার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হবেনা।, এবং এটা আসলেই স্বাভাবিক নয়। এটি একটি মানসিক রোগ।
এই রোগের নাম ডোরোম্যানিয়া ! এই রোগের মানে হচ্ছে, আক্রান্ত মানুষটা আশেপাশের পরিচিত, অল্প পরিচিত কিংবা অপরিচিত সবাইকে কারণে অকারণে উপহার বিলিয়ে থাকেন। এটা এতটাই প্রবল পর্যায় যেতে পারে যে, সে তার সর্বস্ব সহায় বিক্রি করে হলেও উপহার দিয়ে থাকেন।
পরবর্তী পর্বে আমরা আরো কিছু অদ্ভুত মানসিক রোগের কথা তুলে ধরবো। সাথে থাকুন ছারপোকার !