বাংলাদেশের অ্যামাজন, নাম তার রাতারগুল জলাবন। ইংরেজিতে বললে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট (Ratargul Swamp Forest)! পৃথিবীর মাত্র ২২টি মিঠাপানির জলাবনের মধ্যে একটা আছে আমাদের দেশে, এই তথ্যটা জানার পর তো রাতারগুল ঘুরে আসাটা একরকম বাধ্যতামূলক বলাই যায়।
শুভ কাজে দেরি করতে নেই, তাই দুই রাত আর একটা দিনের জন্যে সব কাজকর্ম ফেলে যাত্রা শুরু করলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে নাইট কোচে রওনা দিয়ে সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে। ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা করে নিলাম ওখানেই। আর ভ্রমনকালীন পেটখোড়াকি হিসেবে হালকা খাবার আর পানি নিয়ে রওনা হলাম রাতারগুলের দিকে।
কদমতলী থেকে জাফলং এর বাসে উঠে বসলাম, গন্তব্য আপাতত হরিপুর। ভাড়া জনপ্রতি ২৫ টাকা। হরিপুর থেকে রিজার্ভ সিএনজিতে করে যেতে হলো ৮ কিলোমিটার দূরের ফতেহপুর বাজারে, ভাড়া এবার ১৫ টাকা। সেখান থেকে চৌরঙ্গী ঘাটের অটোরিকশা বা সিএনজি পাওয়া যাবে। দামাদামি করে ১৭০ টাকায় দফারফা হলো।
চৌরঙ্গী ঘাট থেকে মাঝি কাম ট্যুর গাইডের (😉) সাথে দামাদামি করে ৮০০ টাকায় ডিঙি নৌকা ভাড়া করে ঢুকে পরলাম রাতারগুলের ভিতরে। এমন এক সৌন্দর্যের জগতে যা না দেখলে কল্পনা করা যায় না, মুখের ভাষায় বর্ননা করা যায় না, একবার গেলে ফিরে আসতে মন চায় না। পুরো এলাকা জুড়ে ঘন জঙ্গল, অথচ পুরোটাই যেন পানিতে ভাসমান। অচেনা অজানা নানান প্রজাতির গাছগুলো যেন পানির নিচ থেকে মাথা উঁচু করে আমাকেই দেখছে! শহরের যান্ত্রিকতা থেকে অসীম দুরত্বে শুধু আমি, বৈঠার ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ আর মাঝেমধ্যে বন্য প্রানীর চিৎকারে হঠাৎ চমকে উঠা! এই বনে বানর, মেছোবাঘ, শিয়াল আর কাঠবিড়ালি দেখা যায় প্রায়ই। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ আর জোঁকের ভয়ে পানিতে হাত দেইনি।
ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই পুরো বনটা মনের মাধুরী মিশিয়ে চষে ফেললাম। এ যেনো এক স্বপ্নদৃশ্য। বনের মাঝে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে, Ratargul Watch Tower ! এই ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে পুরো বনটা এক পলকে দেখে নেয়া যায়। আর অনুভব করা যায়, আমাদের এই ছোট্ট দেশটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ।
টাওয়ার থেকে নেমে ফের নৌকায় করে চৌরঙ্গী ঘাট, আর সেখান থেকে উল্টোপথে ঢাকায় ফিরে আসাটা শুধুই রাতারগুলের পিছুটান অতিক্রমের গল্প…
এই তো গেলো রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা, এবার ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত কিছু তথ্যের মাথ্যমে জেনে নেয়া যাক রাতারগুল জলাবনের রহস্য…
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট
সিলেট থেকে রাতারগুলের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এই জলাবনের অবস্থান। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একটি পর্যটন কেন্দ্র !
বনবিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, এই বনের আয়তন ৩৩২৫.৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বন ১৯৭৩ সালে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বিশাল এ বনে রয়েছে প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও এখানে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি বানানো হয়।
রাতারগুল বনে সাপের মধ্যে গুইসাপ, জলঢোঁড়া ছাড়াও রয়েছে গোখরাসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের পানি বেড়ে গেলে এসব সাপ গাছের ওপর উঠে পরে।
টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরো অনেক জাতের মাছ আছে এখানকার পানিতে। সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঘুঘু, চিল ও বাজসহ নানা জাতের পাখি দেখা গাছের ডালে। শীতে মাঝেমধ্যে আসে বিশালকায় সব শকুন আর বিভিন্ন জাতের অতিথি পাখি।
রাতারগুল ভ্রমণ সংযুক্তি : নৌকা ভাড়া করার সময় আপনি চাইলে ২০-২৫ টাকায় ছাতা এবং ৫০ টাকায় লাইফজ্যাকেট ভাড়া নিতে পারেন।
সবশেষে একটি অনুরোধ, দয়া করে পলিথিন, বোতল, চিপস কিংবা বিস্কুটের প্যাকেট সহ কোনো প্রকার আবর্জনা পানিতে ফেলবেন না। মনে রাখবেন, রাতারগুল আমাদের সম্পদ। আর আমাদের সম্পদ বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বটাও এই আমাদেরই !