সময়টা ১৯৪২ সালের আগষ্ট মাস। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম নিকৃষ্ট ঘটনা ঘটায় নাৎসিরা। যাকে বলা হয় ম্যাচ অব ডেথ ! যথাক্রমে ৬ এবং ৯ আগষ্ট জার্মান বিমানবাহী নিয়ে গড়া দল ফ্লাকেল্ফ এবং ইউক্রেন এর ক্লাব এফসি স্টার্টের মধ্যে দুটি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ফুটবল ইতিহাসে ৯ই আগষ্টের ম্যাচটি “দ্যা ম্যাচ অফ ডেথ” নামে পরিচিত। কারণ ওই ম্যাচ জয়ের ফলেই এফসি স্টার্টের খেলোয়াড়দের নাৎসী বাহিনীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়।
এফসি স্টার্ট এর ইতিহাস
এফসি স্টার্ট দলটি মূলত ইউক্রেনের কিয়েভ শহরের দুই দল ডায়ানামো কিয়েভ ও লোকোমেটিভ কিয়েভ এর সংমিশ্রণে তৈরি। ৩ জন ইউক্রেনীয় পুলিশ ও একজন ড্রাইভারও দলটির সদস্য ছিল। ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানরা। ১৯৪২ সালের ৭ জুন স্থানীয় লিগে অপ্রতিরোধ্য এক যাত্রা শুরু হয় স্টার্টের। জুন ও জুলাই মাসে তারা মোট সাতটি ম্যাচে লড়াই করে। ৩টি হাঙ্গেরিয়ান মিলিটারি দল, ১টি জার্মান মিলিটারি দল, ১টি জার্মান রেলওয়ে দল এবং দুইটি ইউক্রেনীয় দলকে তারা ভূপাতিত করে। মাত্র ৮ গোল কনসিড করে ৭ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে ৩৭ বার বল জড়ায়।
ম্যাচ অফ ডেথ এর উৎপত্তি
আগষ্টের ৬ তারিখ জার্মানির বিমানবাহিনী নিয়ে গড়া শক্তিশালী দল ফাকেল্ফকে ৫-১ গোলে হারায় এফসি স্টার্ট। জার্মান হাই কমান্ড বিচলিত হয়ে পড়ে। ঠিক মত খেতে না পারা, অনুশীলন করতে না পারা দলের কাছে শক্তিশালী জার্মান দলের এই করুণ হার চরমভাবে অপমান করে হিটলারকে। তাই প্রতিশোধ নিতে নাৎসিরা একটি পাল্টা ম্যাচ খেলার আহবান জানায় এফসি স্টার্ট কে।
দ্যা ম্যাচ অফ ডেথ
কানায় কানায় পূর্ন জেনিত স্টেডিয়ামে ৯ই আগষ্ট আবারো মুখোমুখি হয় দুই দল। ম্যাচ শুরুর ঠিক আগ মুহুর্তে এক নাৎসি গেস্তাপো অফিসার (যিনি ম্যাচের রেফারি ছিলেন) এফসি স্টার্ট এর ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করে। তিনি ওই দলের খেলোয়াড়দের ম্যাচ শুরুর সময় জার্মান কমান্ডারদের নাৎসি স্যালুট দিতে এবং ম্যাচটিতে হেরে যেতে আদেশ করেন। ম্যাচে দাপট দেখিয়ে জয়লাভ করলে তাদের সবার পরিনতি যে মৃত্যুদণ্ড হবে সে হুমকিও দেন।
এফসি স্টার্টের ফুটবলাররা স্যালুট না দিয়ে সাহসিকতার প্রমান দেন। যথারীতি শুরু হয় ম্যাচ। একের পর এক ফাউলের শিকার হন এফসি স্টার্টের খেলোয়াড়রা কিন্তু রেফারি ওসব নিষিদ্ধ ফাউল এড়িয়ে যান।
ম্যাচের শুরুতেই এগিয়ে যায় জার্মানরা। এরপর ইভান কুজমেঙ্কো ও মাকার হঞ্চারেকোর জোড়া গোলে ৩-১ গোলে এগিয়ে থেকে প্রথমার্ধ শেষ করে এফসি স্টার্ট। হাফ টাইমের সময় বিরতিতে আরেক নাৎসি অফিসার তাদের ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করে তাদেরকে ম্যাচটি হেরে যেতে বলে। এতেও বিচলিত হয় না তারা। ৯০ মিনিট শেষে ৫-৩ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে।
ম্যাচ শেষে জার্মানরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, এমনটা প্রকাশ করার জন্য এফসি স্টার্টের খেলোয়াড়দের সাথে হাসিমুখে ছবি তুলে।
এফসি স্টার্ট দলের খেলোয়াড়দের শেষ পরিণতি
১৬ই আগস্ট ইউক্রেনীয় দল রুখকে ৮-০ গোলে হারায় এফসি স্টার্ট। ঠিক তার দুইদিন পর ১৮ই আগষ্ট জার্মান গেস্তাপো ৬ এফসি স্টার্টের ৬ জন এবং ২০ আগস্ট আরো দুইজন খেলোয়াড়কে গ্রেপ্তার করে। লোকোমেটিভ ক্লাবের ৩ জন খেলোয়াড়কে জার্মানরা গ্রেপ্তার করেনি।
৩ পুলিশ সদস্যের একজন “তাচেঙ্ক” কে নাৎসী বাহিনী কিয়েভের রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে। এফসি স্টার্টের স্ট্রাইকার কোরোৎকিখকে তারা টর্চার করতে করতে মেরে ফেলে। বাকি খেলোয়াড়দের বাবি ইয়ারের ডেথ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ৬ মাস পর ট্রুসেভিচ, কুজমেঙ্কো ও ক্লিমেঙ্কোকে ডেথ ক্যাম্পে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়।অনেক অত্যাচার সহ্যের পর হঞ্চারেঙ্কোকে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তী দশকে মিডিয়ার কাছে ডেথ ম্যাচের বিবরণী তুলে ধরে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ডেথ ক্যাম্প থেকে পুতিস্তিন ও তিউতচেভ মুক্তি পায় । তাছাড়া দলের আরেকজন পুলিশ বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানদের সাহায্য করার অভিযোগে ৫ বছর জেল খাটে।১৯৪৫ সালের ১৪ই মার্চ রাদোমস্কি খুন হয়।
১৯৮১ সালে ডেথ ম্যাচের বীর যোদ্ধাদের সম্মানে জেনিথ স্টেডিয়ামের নাম বদলে রাখা হয় স্টার্ট স্টেডিয়াম। তাছাড়া এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে অনেক বই লেখা হয় এবং সিনেমাও বানানো হয়। সিনেমাগুলো হচ্ছে –
- Two half Times in hell (1962)
- Match (2012)
- The Death Match : Dynamo Kiev vs. the Nazis (2008)
- Dynamo: Defending the Honor of Kiev (2001)
- The Longest Yard (1974)
- Escape to Victory (1981)