সতেরশো শতাব্দীতে ইস্তাম্বুলের ইযেনেকাপি নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এক জেলে। হঠাৎ সে দেখে পাড়ে কাচের মত একটি বস্তু চকচক করছে। কাঁচের তুলনায় একটু বেশিই চকচক করছে। মনে আশা নিয়ে তিনি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে যান এক স্বর্ণকারের দোকানে। কিন্তু তিনি হতাশ হলেন। স্বর্ণকার জিনিসটা পরীক্ষা করে দেখে বললো, এটা কাঁচ ছাড়া কিছুই না। তখন তিনটি চামচের বিনিময়ে তিনি কাঁচখণ্ডটি বেচে দিলেন স্বর্ণকারের কাছেই। মাত্র তিনটা চামচ !
কিছুদিন পরে সেসময়কার অটোমান উজির ওই দোকানটির পাশ দিয়ে যাবার সময় কাঁচখণ্ডটি দেখলেন। তিনি ওটাকে হীরা ভেবে কিনে নিলেন। এরপর থেকেই এই অমূল্য কাঁচখণ্ডটি থেকে যায় অটোমান প্রাসাদে। এর নাম দেয়া হয় স্পুনমেকারস ডায়মণ্ড।
অটোমান সাম্রাজ্য, শক্তি সম্পদ আর ঐতিহ্যের দিক থেকে এতটা প্রতাপশালী সাম্রাজ্য ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। যুদ্ধজয়ের পাশাপাশি শিক্ষা ও শিল্পের অসাধারন পৃষ্ঠপোষক এই সাম্রাজ্য তার অসাধারণ স্হাপত্যের মাধ্যমেই যেনো নিজেদের অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্বকে জাহির করেছে। অটোমান রাজবংশের যেসব সম্পদ বা নির্মাণ সবসময় চুম্বকের মত আকর্ষণ করেছে, তার একটি হচ্ছে এই ‘স্পুনমেকারস ডায়মণ্ড’। ৮৬ ক্যারেট ওজনের পৃথিবীতে পাওয়া চতুর্থ বৃহত্তম এই হীরকখন্ডের প্রাপ্তি এবং নামকরণ নিয়ে বেশকিছু কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে কোনটা প্রকৃত, তা আজও অজানা।
শতবছর ধরে অটোমান সাম্রাজ্য পরিচালনার মূল কেন্দ্র বিখ্যাত তোপকাপি প্রাসাদের বিখ্যাত রাজকীয় ট্রেজারীর তৃতীয় কক্ষে এই বিখ্যাত হীরকখণ্ডটির চারপাশে আরো উনপঞ্চাশটি কাটা হীরা জুড়ে লকেট বানিয়ে কাঁচের কেইসে বিশেষ নিরাপত্তার মাঝে রাখা আছে। হীরকখণ্ডটিতে আলো ফেললে পূর্নিমার মতো আলো ছড়ায়। তবে ডায়মণ্ডটির প্রাপ্তি নিয়ে আরও কিছু কাহিনী বিদ্যমান…
প্রথমটা মূলত মিথ ! ঐতিহাসিকরা বলেন, দেখতে স্রেফ চামচের মত বলেই এই হীরকখণ্ডটির এমন নামকরণ…
দ্বিতীয়টাকে বলা হয় সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী ! ১৭৯৭ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ ইপিরাসের প্রিভেজা শহর ফ্রান্সের সম্রাটের অধীনে চলে যায়। তো পরের বছর অটোমান সাম্রাজ্যের তেলেপনা (গ্রিস ও আনাতোলিয়া) অঞ্চলের গভর্ণর আলি পাশা ও তার পুত্র মুহতার ৭ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রিভেজা শহর আক্রমণ করে নিকোপলিসের যুদ্ধ জিতে পুনরায় দখল করেন এবং ফরাসী সেনাপতি লুই আগষ্টি ডি কামুস ডি রিসেমোসহ আরও নয়জন উচ্চপদস্হ ফরাসী কর্মকর্তাকে বন্দি করেন। জিম্মি হিসেবে নিয়ে বন্দি করে রাখেন ১৮০১ পর্যন্ত, যতক্ষণ না ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়নের মা লেতিজিয়া রামোলিনো স্পুনমেকারস ডায়মণ্ডের বিনিময়ে কামুসকে ছাড়িয়ে আনেন।
কথিত আছে জেনারেল কামুস লেতিজিয়ার গোপন প্রেমিক ছিলেন। তখন ডায়মণ্ডটি আসে আলী পাশার কাছে যা তিনি তার স্ত্রী কিরা ভাসিলিকে উপহার দেন। আলী পাশা অটোমান সাম্রাজ্যের কর্মচারী হলেও স্বাধীনচেতা ছিলেন। তার এলাকা স্বাধীনভাবে চালাতেন এবং এটা নিয়ে রাজবংশের সাথে বরাবরই তার দ্বন্দ ছিল। তাই অবশেষে রাজবংশ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে এবং পদচ্যুত করে হত্যা করে আলী পাশাকে। অধীনে আনে আলী পাশার সমস্ত কিছু।
সেই থেকে স্পুনমেকারস ডায়মণ্ড তোপকাপি প্রাসাদের শোভা বৃদ্ধি করছে। পরাক্রমশালী অটোমান রাজবংশের গর্বের মুকুট হিসেবে এই হীরকখন্ডটি বহুদিন ধরে বিদ্যমান। রাজবংশের প্রতিটি সুলতানের স্ত্রী ও বালিদ সুলতানের (সুলতানের মা) পরম আরাধ্য বস্তু ছিলো এই হীরকখন্ডটি। পরবর্তী পোস্টে এই বিষয়েও লিখে ফেলবো। ধন্যবাদ…
[লেখককে ফেসবুকে ফলো করুন : সামিউল ইসলাম প্রত্যয়]