সুপারহিরো বলতে আমরা কি বুঝি? বিদেশী সিনেমা দেখে যা মনে হয়, সুপারন্যাচারাল পাওয়ার সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি যে কিনা ভিলেনের হাত থেকে নায়িকা ও সমাজকে উদ্ধার করে। ব্যাস এতটুকুই ! চলুন আজ আপনাদের একজন সত্যিকারের রিয়েল লাইফ সুপারহিরোর গল্প শোনাই। যে কিনা নিজস্ব স্বকীয়তা, ইচ্ছা, প্রতিভা আর সাহসের মাধ্যমে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সিনেমার যেকোনো কাল্পনিক সুপারহিরোকে ! এই সুপারহিরোর জন্ম আমাদের বাংলাদেশে।
১৯৫০ সালের কথা, আজিমপুরের ১০ নং সরকারী কোয়ার্টারে থাকতেন মোহাম্মদ আফতাব উদ্দীন খান ও জোবেদা খাতুন দম্পতি। ওই বছর ২৮-শে ফেব্রুয়ারি মা জোবেদা খাতুনের কোল আলো করে জন্ম নিলো এক রোগা-পটকা শিশু। বাবা নাম রাখলেন মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। কে জানত একদিন এই রোগা ছেলেটাই সারা দেশে পরিচিত হবে পপ সম্রাট আজম খান নামে !
৩ ভাই ও ১ বোনের সাথে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন আজম খান। ১৯৫৫ সালে বাবা ভর্তি করিয়ে দিলেন ঢাকেশ্বরী স্কুলের বেবী ক্লাসে। এই স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলেও বেশিদিন থাকেননি এখানে। এক বছর পরেই ১৯৫৬ সালে পরিবার সহ তার বাবা কমলাপুরে নিজের বাড়িতে উঠেন। সেখানে আজম খান ভর্তি হলেন প্রভেনশিয়াল স্কুলে। ১৯৬৫ সালে তিনি সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হন, সাবজেক্ট নিলেন কমার্স। ১৯৬৮ সালে এখান থেকেই মেট্রিক পাশ করে টিএন্ডটি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকেই ১৯৭০ সালে সেকেন্ড ডিভিশনে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তারপর দেশে যুদ্ধ শুরু হলে আর কখনো শিক্ষাঙ্গনে পা রাখা হয়নি পপ সম্রাটের।
গান বাজনার প্রতি আজম খানের আকর্ষণ প্রকাশ পায় ষাটের দশকের শুরুতেই। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আজম খান পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এসময় তিনি ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে গণসংগীত প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন।
একাত্তরের যুদ্ধে আজম খান
১৯৭১ সালে আজম খান তার বাবার অনুপ্রেরনায় যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। দুই বন্ধুসহ পায়ে হেঁটে চলে যান আগরতলায়। সেখান থেকে যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্যে যান ভারতের মেঘালয়ের মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখানেও নিজের গানের মাধ্যমে সহযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগাতেন এই সুপারহিরো।
প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লা অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরে তাকে ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধের জন্যে পাঠানো হয়। আজম খানকে তখন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তার সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল খালেদ মোশাররফ। সেকশন কমান্ডার হিসেবে তিনি যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন। তার অপারেশন গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলো ‘অপারেশন তিতাস’। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপালাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও হোটেল পূর্বাণীর গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া। যাতে করে ওসব হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা বুঝতে পারে যে গেরিলা বাহিনী ঢাকায় তাদের অবস্থান ধরে রাখছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাত পেয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে তার শ্রবণশক্তিতে বিঘ্ন ঘটায়।
সঙ্গীত জগতে আজম খানের সূচনা
ষাটের দশকের শুরুতে আজম খান টুকটাক মিউজিক শুরু করেন। যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে তার বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেককে ড্রামে আর নিজেকে লিড ভোকাল নিযুক্ত করে গঠন করেন তার ব্যান্ড দল ‘উচ্চারণ’। এই সময় তাদের ব্যান্ড বিটিভি-তে একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। তাদের গাওয়া ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দিবে’ গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর পরপরই সারাদেশে পরিচিতি পেয়ে যায় তাদের ব্যান্ড। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ (রেল লাইনের ওই বস্তিতে) গানের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যান গুরু আজম খান। পরে তিনি ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীর আর পিলু মমতাজের সাথে বেশ কিছু জনপ্রিয় গান উপহার দেন ভক্তদের। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ‘জীবনে কিছু পাবোনা’ টাইটেলে একটা এসিড রক ঘরানার গান করেন, এটাই বাংলা গানের ইতিহাসে প্রথম হার্ড-রক।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশে তরুণদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ছোট বড় অনেকগুলো ব্যান্ডদল, যারা প্রত্যেকেই আজম খানকে নিজেদের গুরুর মর্যাদায় বসিয়েছেন।
অদেখা অজানা আজম খান
গান ছাড়াও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিলো আজম খানের। ১৯৯১-২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু টিভিসি-তে মডেলিং এর পাশাপাশি ‘গডফাদার’ নামক একটা সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বেশ সংসারি ছিলেন আজম খান। ১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি শাহেদা বেগম -কে বিয়ে করেন তিনি। ২ মেয়ে ও ১ ছেলের বাবা আজম খান স্ত্রী মারা যাবার পর আর বিয়ে করেননি। উনার বড় মেয়ের নাম ইমা খান ও ছোট মেয়ের নাম অরণী খান, একমাত্র ছেলে হৃদয় খান।
সিনেমার সুপারহিরোরা অমর হয়। বাস্তবের সুপারহিরোরা মারা যায়, শেষজীবনে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। পপসম্রাট আজম খান দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে সিএমএইচ হসপিটালে ২০১১ সালে মারা যান। দিনটা ছিলো ৫ই জুন, রবিবার। সেদিন সকাল ১০:২০ মিনিটে একজন কিংবদন্তী লেপ্টে যান ইতিহাসের পাতায় !