তাকে ভালোবেসে অনেকেই মিনিস ক্যাট অফ শিকাগো টাউন বলে ডাকেন। কিন্তু আইনের চোখে তিনি একজন গডমাদার, একজন গ্যাংস্টার ! তাহলে ভালোবাসা কেনো? এজন্য জানতে হবে মা বারকার (আসল নাম কেট বারকার, Kate Barker) নামের এই নারীর ইতিহাস। আসল নাম কেট বারকার হলেও তার কর্মকাণ্ডের শুরুতে মা বারকার (MA Barker) নামেই তিনি পরিচিতি পান। এছাড়াও Bloody Mummy নামেও তার বেশ পরিচিত ছিলো।
১৮৭২ সালে আমেরিকায় জন্ম নেওয়া মা বারকার সম্পর্কে যে তথ্যগুলো জানা যায়, তারমধ্যে বেশ অমিল রয়েছে। আমি এই লেখাটি লিখছি ১৯৭৭ সালে জনপ্রিয় ব্যান্ডদল বনি এম (Boney M.) এর প্রকাশিত একটি অ্যালবামে তুলে ধরা মা বারকার এর জীবনীর অংশ থেকে।
চতুর্থ সন্তান জন্মের পরে অত্যাচারী স্বামী, মা বারকারকে ছেড়ে চলে যায়। তখন বেশ কষ্টে পরে যান এই নারী। চার চারটি শিশুকে নিয়ে জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকা মুখের কথা নয়। অনেক সংঘাত ও বিপর্জয় অতিক্রম করে এক সময় সন্তানরা বড় হয়। ঠিক যেনো বাংলা সিনামার দৃশ্য ! মায়ের উপর বিভিন্ন সময় অত্যাচার করা ধনবান কুটিল চরিত্রগুলোকে সমাজ থেকে মুছে দিতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয় চার ভাই। এভাবেই তৈরী হয় মা বারকার এর আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাং, দ্যা বারকার গ্যাং !
আইনের চোখে অপরাধী হলেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে একজন লিজেন্ডারি কুইন ছিলো কেট বারকার, অর্থাৎ মা বারকার। “Freeze I’m ma Baker. Put your hands in the air and give me all your money” মা বারকারের কমন এই ডায়ালগটি মানুষের মুখে মুখে ছিলো। এবং এই ডায়ালগটি এপর্যন্ত বেশ কয়েকটি গানেও ব্যবহার করা হয়।
ব্যাংক ডাকাতি, কিডন্যাপিং, ডাকাতি, এই কাজ গুলোর মাস্টারমাইন্ড ছিলো মা বারকার, বর্তমানের ইন্টারপোল এখনো তার কৌশলগুলোকে বিবেচনায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। সারাবিশ্বের দুর্ধর্ষ ক্রিমিনালদের মধ্যে এখনো দশ জনের একজন ধরা হয় মা বারকারকে। তবে তার আক্রমণ সবসময় অত্যাচারী কুখ্যাত ধনবান ও অসৎপথে উপার্জনকারীদের বিরুদ্ধেই ছিলো। নিজের প্রয়োজনের পরে বাকি অর্থ সুবিধাবঞ্চিতদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন মা বারকার। সমাজের অর্থলোভী কুটিল চরিত্রগুলোর জন্য সে ছিলো ‘নো হার্ট এট অল’ !
একসময় তারা তাদের এই দলের নাম ‘বারকার কারপিস গ্যাং’ বলে ঘোষনা দেয়। হারমান, লয়েড, আর্থার, ফ্রেড এই চার ছেলে আর মা নিজে মিলে ৫ সদস্য বিশিষ্ট গ্যাং। প্রয়োজনে আরো লোক হায়ার করা হত। তারা মা বেকারের নির্দেশেই কাজ করত। ক্যালিফোর্নিয়া, ওহাইও, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, হাভানা, কিউবা পর্জন্ত ছিলো বারকার কারপিস গ্যাং এর প্রভাব। মা বারকারের হাতে সবসময় থাকত একটা টমি গান। এটা একসময় বারকার কারপিস গ্যাং এর ব্রান্ড অস্ত্র হিসেবে পরিনত হয়। প্রতিটা জায়গাতেই মা বারকারকে টমি গান হাতে দেখা যায়।
মা বারকারের কৌশল, সাহস আর দুর্ধর্ষতার কাছে বারবার পরাজিত হয়ে যাওয়া এফবিআই একসময় তোপের মুখে পরে সমাজের ব্যবসায়ী ও ধনবান শ্রেনীর। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে এই নারী গ্যাংস্টার মা বারকারের নাম। আইনের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড হলেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে সে ছিলো কুইন। সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা থাকলেও আইনের চোখে অপরাধী মানুষের জীবন থাকে সবসময় ঝুঁকিতে। সারা বিশ্বে মা বারকারের ছবিসহ চার ছেলের ছবি ছড়িয়ে দেয় এফবিআই। পরিস্থিতির প্রয়োজনে গা ঢাকা দিতে হয় বারকার কারপিস গ্যাং এর প্রতিটি সদস্যকে।
কিন্তু তারপরও তারা তাদের কর্মসুচি চালিয়ে যাচ্ছিলো। যেখানেই শোষন অত্যাচারের ঘটনা ঘটছিলো, সেখানে বারকার কারপিস গ্যাং গিয়ে তাদের নিজস্ব নিয়মে প্রতিশোধ নিচ্ছিলো আর ধনসম্পদ লুট করে বিলিয়ে দিচ্ছিলো স্থানীয় সুবিধাবঞ্চিতদের মাঝে।
‘Anybody move money, owe your life’ শিরোনামে মা বারকারের একটি নিউজ দৃষ্টি আকর্ষণ করে সারা বিশ্বের। অত্যাচারী মানুষের প্রতি ঘৃনা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এই নারী তখন গল্পের রবিনহুডে পরিনত হতে যাচ্ছে, যা এফবি আইয়ের জন্য ছিলো ভীষণ লজ্জার।
১৯৩৫ সালের ৮ জানুয়ারী একটা ব্যাংক লুট করে ফেরার পথে মা বারকারের ছেলে অর্থার পুলিশের কাছে ধরা পরে। এফবিআই কৌশলে বিষয়টি চেপে যায় এবং আর্থারের কাছ থেকে পরবর্তী ডাকাতির ম্যাপ বুঝে নেয়। বারকার কারপিস গ্যাং এর গোপন আস্তানার ঠিকানা পেয়ে যায় এফবিআই। মা বারকার এবং বারকার কারপিস গ্যাং এর আস্তানায় হানা দেয় এফবিআই, সবাইকে আত্মসমর্পন করতে বলা হয়। কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করার মানুষ মা বারকার ছিলেন না। তিনি তার দলের সকল সদস্যকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে একাই লড়াই শুরু করেন তার প্রিয় টমি গান নিয়ে। মা কে একা ফেলে পালিয়ে যাওয়ার মতো ছিলোনা তার সন্তানেরা। তাই পালিয়ে না গিয়ে তারাও মায়ের সাথে যোগ দেয়। গোলাগুলির এক পর্যায়ে এফবিআইয়ের প্রতারনামুলক একটি কাজে গুলিতে মারা যায় লিজেন্ডারি মা বারকার আর তার দুই ছেলে।
এফবিআইয়ের এক অফিসারের বক্তব্য মতে মৃত্যুর পরে লাশ সরানোর সময়ও মা বারকারের হাতে ধরা ছিলো টমি গান, যা কিনা বহু চেষ্টা করেও তার হাত থেকে সরানো যাচ্ছিলো না। এ যেনো মৃত্যুর পরেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বসস্ত্র সংগ্রাম।
জানা যায়, এফবিআই চাইলে জীবিত অবস্থায় বারকার কারপিস গ্যাংকে আটক করতে পারত। কিন্তু মা বারকারের প্রতি ছিলো তাদের ঘৃনা, আধুনিক ব্যবস্থাপনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সারাবিশ্বের সামনে লজ্জা ফেলে দেয়ার কারনে ! এখনো মা বারকারের জন্য পজেটিভ লেখাগুলো নেটে সার্চ করে খুব কম পাওয়া যায়। অনেকের ধারনা এগুলো সরিয়ে দেয়া হয়।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে লড়ে যাওয়া মানুষ কেট বেকার (মা বারকার) এভাবেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আর সমাজে রয়ে গেছে সেই অত্যাচারী কুটিল চরিত্রগুলো, অসম্পুর্ন আইনের সহায়তায়…