পৃথিবী এবং এর বাইরের দেয়ালবিহীন অসীমতার জগতটাকে জানতে যারা উৎসুক, তাদের কাছে সবচেয়ে রহস্যময় দুটো বিষয় হচ্ছে বিগব্যাং এবং ব্ল্যাক হোল। বলা হয়ে থাকে, বিগব্যাং থেকেই শুরু হয়েছিলো সবকিছুর। আর ব্ল্যাক হোলেই হবে শেষ। এই ব্ল্যাকহোল নিয়েই ছারপোকার আজকের এই পোস্ট !
ব্ল্যাক হোল (Black Hole) বা কৃষ্ণ বিবর কি?
Black মানে কালো, আর Hole শব্দটির অর্থ গর্ত। তবে ব্ল্যাক হোল শব্দটি দ্বারা কোনো কালো গর্তকে বোঝানো হয়না। ব্ল্যাক হোল হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে খুবই অল্প জায়গায় অনেক অনেক ভর ঘনীভূত হয়ে রয়েছে। এই অতি বিশাল ভরের কারণে ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণ বলও অনেক বেশি। এতটাই বেশি যে, কোনো কিছুই এর কাছ থেকে রক্ষা পায় না। এমনকি সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন আলোও নয় !
আরেকটু সহজভাবে বুঝাই। আচ্ছা, আপনি যদি ব্ল্যাক হোলের কাছে গেলে কি হতে পারে?
প্রত্যেকটি ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত আছে, যার সীমানায় কোনো কিছু আসলে ব্ল্যাক হোল সেই জিনিসকে গ্রাস করে। এখন আপনি যদি ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্তে চলে আসেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ব্ল্যাক হোল আপনাকে গ্রাস করবে। বা তার ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে। ঘটনাটা কিভাবে ঘটবে দেখা যাক।
ধরুণ, আপনার পা ব্ল্যাক হোলের দিকে আছে। ফলে আপনার সাথে কি ঘটছে তা দেখতে পাবেন ! পা ব্ল্যাক হোলের দিকে থাকার কারণে আপনার শরীরের নিচের অংশ বেশী আকর্ষণ অনুভব করবে। আকর্ষণের টানে আপনার শরীর চুইং গামের মত হয়ে যাবে। তারপর একসময় আপনার শরীর নুডুলসের মত হয়ে যাবে। অবশেষে একটা সময় আপনার ছিন্নভিন্ন শরীর ব্ল্যাক হোলের একটি বিন্দুতে পতিত হবে। এবং এরপর আপনার ভাগ্যে কি হবে, তা বিজ্ঞানীদের জানা নেই ! তবে খুশির খবর হচ্ছে, ব্ল্যাক হোল আপনার সাথে কিরকম আচরণ করবে, তা জানার জন্যে আপনার ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। বিজ্ঞানীদের বহু বছরের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ দূরত্ব থেকেই এটা জানা যাবে।
আপনি হয়ত জানেন না যে, জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে সূর্যের জ্বলে থাকার ক্ষমতাও একসময় শেষ হয়। সূর্যের চেয়ে কমপক্ষে দশগুণ বড় নক্ষত্রদের জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে এরা সঙ্কুচিত হতে হতে অতি খুদ্র অন্ধকার বিন্দুতে পরিণত হয়। এধরণের ব্ল্যাক হোলকে বলা হয় স্টেলার মেস (Stellar Mass) ব্ল্যাকহোল। বেশীরভাগ ব্ল্যাক হোলই এধরণের। কিন্তু নক্ষত্রের সঙ্কুচিত হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হওয়ার পরও ব্ল্যাক হোলে নক্ষত্রের সমান ভর ও অভিকর্ষ টান থাকে। আমাদের গ্যালাক্সিতে সম্ভবত ১০০ মিলিয়ন ব্ল্যাক হোল রয়েছে। জ্যোতির্বিদদের মতে, প্রতি সেকেন্ডে একটি ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি হয়। আরেক ধরণের ব্ল্যাক হোল হচ্ছে সুপার মেসিভ (Super massive) ব্ল্যাক হোল। তাদের এক মিলিয়ন তারার ভর এমনকি এক বিলিয়ন তারার ভরও থাকতে পারে। সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোলরা কোনো গ্যালাক্সির মিলিয়ন বা বিলিয়ন তারাকে একত্রে ধরে রাখে। আমাদের গ্যালাক্সিতেও কিন্তু একটি সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোল আছে। সেটির নাম Sagittarius A* , যা আবিষ্কৃত হয়েছিলো ৪৪ বছর আগে।
শুরুতেই বলেছি, ব্ল্যাকহোলের আকর্ষণ এতই বেশি যে, এর থেকে দৃশ্যমান আলো, এক্স-রে, অবলোহিত রশ্মি কিছুই রক্ষা পায় না। এজন্যই ব্ল্যাক হোল আমাদের কাছে অদৃশ্য। বিজ্ঞানীরা তাই ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষণা করার সময় খেয়াল করেন ব্ল্যাক হোল তার আশপাশকে কিভাবে প্রভাবিত করছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্ল্যাক হোল থেকে প্রায়ই উজ্জ্বল গ্যাস ও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফোয়ারা নিক্ষিপ্ত হয়। এধরণের পর্যবেক্ষণ থেকেই বিজ্ঞানীরা অতি বৃহৎ ও দারুণ শক্তিশালী ব্ল্যাক হোল আবিস্কার করেন।
বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ Dr. Julie Hlavacek-Larrondo বলেন, “খুব সম্ভবত আমরা যা আশা করেছিলাম, তারচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ব্ল্যাক হোল পাচ্ছি। এবং এটা যথেষ্ট কৌতূহল উদ্দীপক ! আমরা জানি, বড় ব্ল্যাক হোলে অতি শক্তিশালী গ্যাস কিংবা বিকিরণের ফোয়ারা আছে, যা ছড়ালে সহজেই গ্যালাক্সির আকার পার হয়ে যাবে। ভেবে অবাক হতে হয়, এত ক্ষুদ্র কিছু কিভাবে এত বৃহৎ প্রভাব করতে সৃষ্টি করতে পারে” !
ব্ল্যাকহোলের এই উদ্গীরন থেকে আমরা এর আকার সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে Hlavacek-Larrondo ও অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন, কিছু কিছু ব্ল্যাক হোল এতই বড় যে তা ‘আলট্রা মেসিভ’ (Ultra massive) নামের নতুন নামের দাবীদার। এধরণের ব্ল্যাক হোল সূর্যের তুলনায় ১০ বা ৪০ বিলিয়ন গুণ বেশি ভর ধারণ করে।
Jonelle Walsh নামের আরেকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলেন, ৫ বছর আগেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের তুলনায় ১০ বিলিয়ন গুণ ভারী ব্ল্যাক হোলের কথা জানত না। অতি বিশাল ভর যুক্ত এসব ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণ শক্তি এতই বেশি যে তারা গ্যালাক্সি গুচ্ছকে ধরে রাখতে পারে !
আলট্রা মেসিভ ব্ল্যাক হোলরা বিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে ভর অর্জন করে এত বৃহৎ ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়েছে। বড় ব্ল্যাক হোলরা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, এটিই একমাত্র রহস্য নয় ! এই ব্ল্যাক হোলরা কিভাবে সহস্র বিলিয়ন তারা ধরে রাখে তাও বিশাল রহস্য। সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোলরা আগে সৃষ্টি হয়েছে নাকি গ্যালাক্সির গুচ্ছ বা ক্লাস্টার আগে সৃষ্টি হয়েছে, তা আজও অজানা। বিজ্ঞানীরা এখনো এব্যাপারে নিশ্চিত না যে সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোলরা আগে সৃষ্টি হয়েছে, তারপর গ্যালাক্সির গুচ্ছ সৃষ্টি করেছে। হতে পারে গ্যালাক্সি গুচ্ছই আগে সৃষ্টি হয়েছে।
২০১২ সালের একটি আবিষ্কার এই ব্ল্যাক হোল রহস্যকে আরো ঘনীভূত করেছে। Jonelle Walsh ও তাঁর সহকর্মীরা হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে NGC 1277 নামের একটি গ্যালাক্সি আবিস্কার করেছেন। গ্যালাক্সিটি ২০০ আলোক বছরেরও অধিক দূরে অবস্থিত। NGC 1277 এর আকার আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এক চতুর্ভাগ। কিন্তু Jonelle Walsh ও তাঁর সহকর্মীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ৰি গ্যালাক্সিটির কেন্দ্রে একটি ব্ল্যাকহোল আছে, যার আকার এই পর্যন্ত যত বড় ব্ল্যাকহোল আবিস্কার হয়েছে তার একটি। ধারণা মতে, এটি Sagittarius A* এর তুলনায় ৪০০০ গুণ বড় ! Jonelle Walsh এর মতে, ব্ল্যাক হোলটি তার গ্যালাক্সির তুলনায় অনেক বড় !
আগে ধারণা করা হত, ব্ল্যাক হোল ও গ্যালাক্সি একসাথে বড় হয় এবং একসাথেই বড় হওয়া থেমে যায়। কিন্তু এই নতুন আবিষ্কার অনুযায়ী, হয় ব্ল্যাক হোল তার আশেপাশের তারা ও ব্ল্যাক হোল খেয়ে শুধু বড়ই হতে থাকে, অথবা শুরু থেকেই এটি কোনো উপায়ে বেশি বড় হয়ে গেছে।
সব গ্যালাক্সিতেই এধরণের বিন্যাস আছে, নাকি তার উল্টো, অর্থাৎ সহজ ভাষায়, বড় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ছোট ব্ল্যাকহোল আছে কিনা, তা জানতেই এখন অপেক্ষা !
ব্ল্যাকহোল আমাদের এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় একটি ব্যাপার ! বিজ্ঞানীরাও লেগেই আছেন এই রহস্যের পেছনে। একসময় ঠিকই আস্তে আস্তে রহস্যের জাল থেকে বেড়িয়ে আসবে এই রহস্যময় ব্ল্যাক হোল। তখন অনেক কিছুই হয়ত ব্যাখ্যা করা যাবে, যা এখন আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। কারণ পৃথিবী যেদিন ব্ল্যাক হোলের মুখে পতিত হবে, সেদিনই হবে আমাদের গ্রহের শেষ দিন…
Reference :
- Science for kids
- Black hole mysteries by Stephen Ornes
(প্রতিবেদনটি লিখেছেন ছারপোকার ম্যাগাজিন এর প্রতিষ্ঠাতা কাজী নিপু ! ফেসবুকে তাকে ফলো করতে ভিজিট করুন Kazi Nipu পেইজে)