‘ঈদ’ থেকে ‘ইদ’ হয়ে গেলো ৯০ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীর এই দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবটা। তরুণ ও যুব সমাজের কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এই টপিকটা। মোটামুটি সবাই এর বিরোধিতা করলেও ব্যক্তিগতভাবে আমি বিষয়টা একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করলাম !
খানিকটা পিছিয়ে যাই…
৯০ দশকের কথা বলছি। সেসময় আমরা বেশ ছোট হলেও তখনকার ঈদের স্মৃতি খুব ভালোভাবেই মনে আছে এখনো। ঈদের আগে তো রোজা আসে, সেখান থেকেই শুরু করি। কনকনে শীতের মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে সেহেরি করতাম আমরা। গরম পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে খেয়ে দেয়ে আবার মটকা মেরে শুয়ে পরতাম। ওই সময় এলাকার তরুণরা শীতের বুড়িকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দলে দলে পাড়া-মহল্লার অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে ‘কাশিদা’ গেয়ে সবার ঘুম ভাঙাতো। উচ্চস্বরে তারা হামদ-নাত পড়ত কিংবা সমস্বরে ইসলামী গান গাইতো। একেই বলা হতো ‘কাশিদা’।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ঢাকা ও পার্শবর্তী অঞ্চলে প্রথম কাশিদা’র প্রচলন শুরু হয় পাঠান ও মুঘল আমলে। খাঁজা আহসানউল্লাহ্’র যুগে এই কাশিদা আরো উৎকর্ষতা লাভ করে। কাশিদা দলের সদস্য নির্বাচন করত এলাকার পঞ্চায়েতগণ। কালের বিবর্তনে আজ কাশিদা’র স্থান হয়েছে শুধু স্মৃতির পাতায়!
আরেকটা ঐতিহ্য হচ্ছে ইফতারে ছোলা-মুড়ি। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে সারাবছর কোথাও ছোলা-মুড়ি না থাকলেও ইফতারে ছোলা-মুড়ি না হলে যেন চলেই না। কোত্থেকে এর শুরুটা হয়েছিলো সেটা খোঁজার চেষ্টা করে খানিকটা অবাক হলাম। চলে যাচ্ছি ইংরেজদের আমলে…
সেই যুগে চলাচলের প্রধান বাহন ছিলো দুই চাকা ও চার চাকার ঘোড়ার গাড়ি। এসব গাড়ি টানতো হৃষ্টপুষ্ট ও তাগড়া সব ঘোড়া। প্রচন্ড শক্তি যোগাতে এসব ঘোড়াকে সকাল বিকাল প্রচুর পরিমাণে ছোলা খাওয়ানো হত, প্রচুর।
ওদিকে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের জমিদারদের বিষয় সম্পত্তি তদারকির কাজ করত প্রচুর পাইক পেয়াদা, লোকলশকর ও কুলি-কামিনরা। জমিদারদের ধারনা হলো, ছোলা খাওয়াতে যদি ঘোড়ার শক্তি বাড়ে, তাহলে এসব লোকলশকরের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় খানিকটা ছোলা যোগ করলে হয়ত তাদেরও কর্মক্ষমতা বাড়বে। আর এভাবেই নিম্নবিত্ত বাঙালির খাদ্যতালিকায় যোগ হলো ছোলা খাওয়ার প্রচলন !
প্রথমদিকে কাঁচা ছোলা দীর্ঘক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে তারপর খাওয়া হত। পরে সিদ্ধ করে ছোলা খাওয়ার চল শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ছোলার সাথে যুক্ত হলো তেল, পেঁয়াজ, মশলা ইত্যাদি।
পূর্ববঙ্গের হিন্দু জমিদারদের প্রজা ও পাইক-পেয়াদাদের বেশিরভাগই ছিলো দরিদ্র মুসলিম। তারা ভাবত, রোজা রাখার পর খানিকটা ছোলা খেলে হয়তোবা সারাদিনের শারীরিক দুর্বলতা দূর হয়ে শরীরে কিছুটা এক্সট্রা বল পাওয়া যাবে। এরপর ছোলার সঙ্গে যুক্ত হলো মুড়ি। আর পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ ইত্যাদি তো বাঙালির বহুদিনের ঐতিহ্যময় খাবারের অনুষঙ্গ।
ঈদের চাঁদ দেখার কথা বলি, ছোটবেলায় ঊনত্রিশ কিংবা ত্রিশ রোজার ইফতারের পর থেকেই তীর্থের কাকের মত আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম আমরা ছোটরা। কখন সাদা সূঁতার মতো এক ফালি চাঁদ দেখা যাবে আর আমরা দলে দলে ছড়া কাটবো ঈদের খুশিতে!
“চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে
দেখবি কে কে আয়,
নতুন চাঁদের আলো এসে
পরলো সবার গায়!”
রেডিও টিভিতে শুরু হয়ে যেত “..ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানে তাগিদ..”
মাঝেমধ্যে ভাবি, নজরুল সাহেব যদি এই গানটা না লিখতেন, তাহলে বোধহয় আমাদের ঈদের খুশিটা কখনোই পূর্ণতা পেত না।
পাশাপাশি চারদিকে শুরু হয়ে যেত বাজী ও পটকা পোড়ানোর ধুম। শলতা, চকলেট, ঝর্না, মরিচা, তারাবাতি, রকেট ব্যোম সহ আরো কত কি। এখন তো এসব আনন্দ আইন করেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে !
ঈদ উৎসবের এসব রীতি রেওয়াজ চালু হয়েছিলো মূঘল আমলে। ইতিহাস ঘেঁটে আরো জানতে পারি, বাংলায় সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ন ঈদ পালন করা হত এই মূঘল আমলেই। সুবেদার ইসলাম খাঁ প্রথম যখন ঢাকায় আসেন, তখন ছিলো রমজান মাস। সেই বছরই সবচেয়ে জাঁকজমক করে পালন করা হয় ঈদ উৎসব। একদিকে ঈদের আনন্দ, আর অন্যদিকে ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের খুশি। সেই আমলে ঈদের নতুন চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠত শাহীতূর্য। গোলন্দাজ বাহিনী শুরু করত আকাশে আগুন লাগানো নয়নাভিরাম আতশবাজির উৎসব। সন্ধ্যার প্রথম প্রহর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত একটানা বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে এলাকাবাসীর মনে ঈদের আনন্দের রঙ মাখিয়ে দেয়া হত। রাতের শেষ প্রহরের দিকে বন্দুক ছোঁড়া বন্ধ করে গোলন্দাজ বাহিনী বড় কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ শুরু করত। তাতে করে দ্রাম দ্রাম শব্দে প্রকম্পিত হত চারিদিক, দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পরত ঈদের আমেজ।
এখন আর বড় বড় ইট-কাঠের অট্টালিকা পেরিয়ে আকাশ পর্যন্ত কারো চোখ যায় না বোধকরি। ঈদের চাঁদ তো ভরা পূর্নিমার চাঁদের মতো রোমান্টিক নয়, এতে দেখার কি আছে!
আমার বাবার মুখে শুনেছি, ঈদ আনন্দের আরেকটা বড় অংশ ছিলো মেলা। ঈদ উপলক্ষে শুধু গ্রামে-গঞ্জেই যে মেলা বসত, তা কিন্তু নয়। আশির দশকেও খোদ ঢাকা শহরেই বসতো বড় বড় নাম করা সব মেলা। ধানমন্ডি, রমনা, পল্টন ময়দান, ইসলামপুর, চকবাজার এবং ধূপখোলা মাঠে মেলা ছিলো বিখ্যাত। নাগরদোলা থেকে শুরু করে বাঁশের বাঁশি, টিনের তলোয়ার, প্লাস্টিকের ছোট বায়োস্কোপ, লাল-নীল কাগজের হরেক রকমের খেলনা কত কিছু যে পাওয়া যেত মেলায়, সেটা বলে শেষ করা যাবে না। থাকত নানারকম খাবার – খই, কদমা, মণ্ডা, মুড়ি, মুড়কি, মোয়াসহ অন্যান্য মুখরোচক সব খাদ্য দ্রব্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে বরফ ওয়ালার কাছ থেকে কিনে নিত কুলফি বরফ, রাঙা শরবত, গোলাপি লজেঞ্জুস কিংবা হাওয়াই মিঠাই।
ঈদের নামাজের পরেই লেগে যেত কোলাকুলির ধুম। পরিচিত-অপরিচিত, পাড়া-প্রতিবেশি, শত্রু-মিত্র সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরার এক মোহনীয় প্রথা। আর এখন তো আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া কোলাকুলির কথা ভাবতেই পারিনা 😛
বাচ্চারা দল বেঁধে বেড়িয়ে পরতাম সালামীর কালেকশনে। কে কতো বেশি সালামী আদায় করতে পারি তার প্রতিযোগিতা। এখন এসব ভাবাই যায় না!
এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে ঈদের দিনও যেন অন্যান্য দিনের মতোই আরেকটি দিন। আমাদেরই বা কত বয়স হয়েছে ! আমরাও তো এখন আর আগের মত খোশ আমেজ নিয়ে ঈদ উৎসব করতে পারিনা। কিন্তু সেই সময়ে ঈদ যে কি পরিমাণ খুশির বার্তা নিয়ে আসত সেটা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়ত কখনোই বুঝতে পারবে না। হয়ত এসব কারণেই তখনকার ঈদ ‘ঈদ’ ছিলো, আর এই নতুন যুগের ঈদকে ‘ইদ’ বলাটাই বেটার !