মৃত্যু, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর এবং রহস্যঘন শব্দ। মৃত্যুর অনুভূতি কেমন, তা হয়ত জীবিত মানুষের পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত্যুর ভয়াবহতা সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা যায়।
একটু কল্পনা করেন তো, প্রতিদিনকার মত পরিবারের সবার সাথে রাতের খাবার শেষ করে শুয়ে পড়লেন। আপনজনের সাথে গুটুর-গুটুর গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেলেন। গভীর ঘুমের কোনো এক পর্যায়ে কয়েক টন কাঁদা মাটি, পাথরের কণা ও গাছপালা এসে পরলো আপনার বুকের উপর। কাঁদা মাটির নিচে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন আপনি। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আপনি মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় পাবেন। এবং ওই সময়ে বেঁচে থাকার বৃথা চেষ্টা করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না আপনার হাতে !
কি? বিভৎস মনে হচ্ছে? খুব অসহায় ও করুণ মনে হচ্ছে?
অথচ সম্প্রতি এরকম একটা ঘটনাই ঘটে গেলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ধ্বসে নিহত ১৫৬ জন মানুষের সাথে। দেশের নামে নিজের জীবন উৎসর্গ করা সেনাবাহিনীর ছয়জন বীর সদস্য মারা গেলো এই দেশেরই মাটির চাপায়। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও যারা জানতেন না, কিরকম এক ভয়াবহ দুঃসহ অভিজ্ঞতার স্বীকার হতে যাচ্ছেন তারা।
এ ঘটনা আজ নতুন নয়। প্রতিবছরই এরকম ভারী বর্ষণের মৌসুমে কমবেশ পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কেনো ঘটছে?
পাহাড় ধ্বসের পেছনে দুই ধরনের কারণ বিদ্যমান, প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণ !
- প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে আছে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, পাহাড়ের পাদদেশে নদী কিংবা সাগরের ঢেউ আঘাত করা ইত্যাদি।
- আর মানবসৃষ্ট কারন গুলো হচ্ছে, পাহাড়ের মাটি কেটে ফেলা, গাছপালা কেটে ফেলা, পাহাড়ের ঢালে অতিরিক্ত ভার দেয়া, পাহাড়ি খাল কিংবা ঝর্ণার প্রকৃতিক গতিপথ পরিবর্তন করা, খনি উত্তোলন করা ইত্যাদি।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলাদেশে মূলত পাহাড়ের উপরের দিকে কঠিন শিলার অভাব, একইসাথে পাহাড়ের মাটি এবং বড় গাছপালা কেটে ফেলার কারণেই পাহাড় ধ্বস হয়ে থাকে।
ভৌগলিক নিয়মেই বাংলাদেশের পাহাড় গুলোর উপরের দিকে কঠিন শিলার আস্তর নেই। যার ফলে পাহাড়ের মাটি সহজেই বৃষ্টির জল শুষে নিয়ে ফেঁপে উঠে এবং একসময় নরম হয়ে ধ্বসে পরে। এছাড়া যারা পাহাড়ে থাকেন, তারা ঘরবাড়ি নির্মানের সময় উপরের সবচেয়ে কঠিন মাটির স্তরও কেটে ফেলেন। যার ফলে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা আরো তীব্র হয়।
সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে পাহাড়ী গাছপালা কেটে ফেলা। সরকার আইন করে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চলের গাছপালা কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই শেষ। আইন আর বাস্তবায়ন করার সময় হয়নি। সমতলের ব্রিকফিল্ড গুলোর চাহিদা মেটাতে পাহাড়ী বাসিন্দারা নির্বিচারে গাছপালা কেটে বিক্রি করছে। শূন্য করে দিচ্ছে পাহাড়ের বুক। প্রতিদানে পাহাড়ও সময়মত তার প্রতিশোধ নিতে ভুল করছে না। টাকার লোভে পাহাড়ীরা নিজেদের জীবন সংকট যে নিজেরাই ডেকে আনছে সেটা কে বুঝাবে তাদের !
ওদিকে পাহাড় ধ্বসের কারণে পার্বত্য অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে, সমতল ভূমিতে পাহাড়ি মাটি নেমে আসাতে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম তরতরিয়ে বেড়ে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় সাময়িক দুর্ভিক্ষের।
সরকারী হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বনভূমি বর্তমানে ১১.০৫%, বেসরকারি হিসেবে যেটা ৯.৭১% ! অথচ একটা দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে কমপক্ষে ১৭% বনভূমি থাকা প্রয়োজন।
যাইহোক, আমাদের দেশের উক্ত ৯.৭১% (কিংবা ১১.০৫%) বনভূমি’র এক বিশাল অংশ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সুতরাং এসব গাছপালা কাটার ফলে শুধুমাত্র নিজেদেরই নয়, বরং সমগ্র দেশের এবং প্রকৃতির বৈশ্বিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
ফিরে আসি আমাদের সাম্প্রতিক দুর্যোগ প্রসঙ্গে,
২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলাতেই পাহাড় ধ্বসে নিহত হয়েছে ২ শতাধিক মানুষ। আর পুরো পাহাড়ি জেলাগুলোতে বিগত বছর দশেক সময়ে নিহতের সংখ্যা অনেক অনেক গুণে বেশি, যার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র পাইনি আমি।
অথচ এতকিছুর পরেও আমরা নির্বিকার। আমরা দেখছি, শুনছি, ফেস্বুকের টাইমলাইনে শোক প্রকাশ করছি, তারপর ভুলে যাচ্ছি…
জনগণের এরকম নির্বিকার থাকার কারণেই হয়ত সরকারও এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে উদাসীন। অবিলম্বে পাহাড় ধ্বসের কারণগুলো বিবেচনায় এনে একটা নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরী এবং কঠোরভাবে প্রয়োগ না করলে পাহাড় ধ্বসের মত মানবিক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না। প্রয়োজন সচেতনতার…