মৃত্যু নিয়ে ভয়ভীতি বা দুশ্চিন্তা কি আমাদের কোনোরকম উপকারে আসে? উঁহু, একদমই আসেনা। তবে হ্যাঁ, মৃত্যুভাবনা মানবজীবনে অনেক প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।
মৃত্যু ভীতির সাথে মৃত্যু ভাবনাকে মিলিয়ে ফেলবেন না। দুটো সম্পূর্ণই দুই প্রান্তের বিষয়। মানুষ মরণশীল। আমরা প্রত্যেকেই জানি জীবনের কোনো একটা সময়ে মৃত্যু এসে আমাদের সব অ্যাডভেঞ্চারগুলোর ইতি টেনে দিবে। তবুও আমরা সবসময় এই স্বাভাবিক বাস্তবতা ভুলে থাকতে চাই। কারণ মৃত্যু শব্দটা শুনতেই এক হিমশীতল অনুভূতি ঘিরে ধরে আমাদের। কিন্তু কিভাবে এই মৃত্যুটাকে আরেকটু সুন্দরভাবে বরণ করে নেয়া যায়, তা নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবিনা। ভয় পর্যন্তই শেষ…
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মৃত্যু অতিপ্রাকৃতিক একটা বিষয়। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং মৃত্যু নিয়ে নিয়মিত চিন্তা মানুষকে আরো বেশি জীবনমূখী করে তোলে। গুছিয়ে দেয় জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো। তাই শুধু এটুকুই মাথায় রাখা উচিত, মৃত্যুর আগে জীবনকে কতটা উপভোগ করে নেয়া যায়। যে পৃথিবীর আলো বাতাস অক্সিজেন খরচ করছি, সেই পৃথিবীর জন্য কতটা করা যায়। চারপাশের যে মানুষগুলোর ভীড়ে আমরা বড় হচ্ছি, যারা আমাদের একা থাকতে দিচ্ছেনা, তাদের জন্য ঠিক কতটুকু করা যায়। অবশ্যই সবাইকে অনেককিছু দেয়ার আছে আমাদের। শুধু খেয়ে দেয়ে মরে যাওয়ার জন্যই তো আর মানুষের জন্ম নয় !
আর কথা না বাড়িয়ে চলুন জেনে নেয়া যাক, মৃত্যুভাবনা (Death Acceptance) ঠিক কিভাবে এবং কি কি উপায়ে আমাদের সাহায্য করে প্রতিনিয়ত –
লক্ষ্য নির্ধারণ করতে : জীবনের লক্ষ্য আমরা সবাই কমবেশ নির্ধারণ করি। কিন্তু একজন মৃত্যু সচেতন ব্যক্তির কাছে জীবনের মানে আর ১০ জন থেকে অনেক আলাদা। সে জীবনকে অনুধাবন করে ভিন্ন উপায়ে, ভিন্ন আঙ্গিকে। তাই তার নির্ধারিত লক্ষ্য হয় আরো সুদূরপ্রসারী। সেখানে মিশে থাকে গভীরতা, মিশে থাকে আশপাশের আত্মীয় পরিজনকে নিয়ে তার চিন্তা, জীবনবোধ ইত্যাদি।
একজন মানুষের মাঝে যখন মৃত্যুভাবনা থাকে না, তখন সে তার জীবন নিয়ে যেকোনো রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং নিয়েও ফেলে। অন্যদিকে জীবন নিয়ে সচেতন একজন ব্যক্তি হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। সে সবসময়ই ভেবে দেখে, যে পথ ধরে সে হাঁটতে যাচ্ছে, কোনো অনিশ্চয়তা সেই পথ আটকে দিবে কিনা ! তখন আর সে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। বাধ্য হয় গুছিয়ে ভাবতে !
জীবনকে ভালবাসতে : জীবনকে তো আমরা সবাই ভালবাসি। কিন্তু এই জীবন তো আর চিরকালের নয়। আত্মার ভেতর থেকে এই বোধটা যখন মানুষের মাঝে তৈরি হয়, তখন সে জীবনের মূল্য বুঝতে পারে। খেয়াল করে দেখবেন, একজন সংসারি মানুষ কিভাবে রাস্তা পার হয় ! আর একজন তরুণ কিভাবে দ্রুতপায়ে সেই একই রাস্তা পেরিয়ে যায় ! সংসারি মানুষটি হয় দায়িত্বশীল। মৃত্যুর ভয় আছে তার। জীবন তার কাছে অনেক দামী। তাই সে সাবধানী। আর তরুণ যুবকের মাঝে এসব ভাবনা নেই, পিছুটান নেই। সে জীবন নিয়ে অত বেশি সচেতন নয়।
এ থেকেই বুঝা যায়, মৃত্যুভাবনা কিভাবে জীবনকে আরো অর্থবহ করে, কিভাবে মানুষকে আরো কর্মঠ করে !
জীবনের গতি বৃদ্ধি করে : মানুষ যখন জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে সচেতন, তখন সে তার প্রতিটা দিনের এক বিন্দু পরিমাণ সময় নষ্ট করতে চায় না। কারণ কাল সামনে কি আছে, তা সে জানে না। তাই সে কখনোই আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখবে না। প্রতিদিনের কর্মসূচি গুছিয়ে প্রতিটি কাজ শেষ করতে চাইবে। উপভোগ করতে চাইবে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত। অন্যরা যখন ভাবনা-বিলাসিতায় ব্যস্ত, একজন জীবন-সচেতন মানুষ তখন জীবনকে দিতে চায় ভিন্ন ‘মানে’। বলতে চায়, তার আরো অনেক কিছু করার আছে জীবনে। আরো অনেক কিছু দেয়ার আছে এই পৃথিবীকে।
দূরদৃষ্টি তৈরি করে : মৃত্যুভাবনা মানুষের মাঝে দূরদৃষ্টি তৈরি করে। মানুষ তখন জীবনকে আর একভাবে চিন্তা করে না। যেকোনো বিষয়ের গভীরে ঢুকে সে জেনে নিতে চায় এর সবটা। তার দেখার চোখ বদলে যায়, ভাবনার গতি বদলে যায়। সমাজ সম্পর্কে তার মতাদর্শ, দেশ সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ হয় একেবারেই ভিন্ন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মৃত্যুচিন্তাকে ভয় করে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের চেয়ে, মৃত্যুর সম্ভাবনাকে মেনে নেওয়া মানুষেরাই বেশি জ্ঞানী এবং তাদের জীবনবোধও অনেক উন্নত !
স্থিতিশীল জীবনের জন্য : মৃত্যুভাবনা একটা মানুষের জীবনকে আরো স্থিতিশীল করে মৃত্যুকে মেনে নিতে তাকে সাহায্য করে। আপনি যখন অনিশ্চয়তা সম্পর্কে সচেতন থাকেন, তখন আপনি আপনার প্রতিটা পদক্ষেপ নেন ভেবে চিন্তে। আপনি তখন ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করেন। চিন্তা করেন সবার জন্য। শুধু নিজের কথা ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। তাই না? ঠিক সেভাবেই ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে একজন সচেতন ব্যক্তি সচেতনতার সাথেই বিভিন্ন পরিকল্পনা করে। তিনি যতদিন বেঁচে থাকেন, ততদিন স্থিতিশীল জীবন কাটাতে চান। তাই তিনি ব্যক্তি হিসেবে অস্থির চিত্তের না হয়ে বরং হয়ে ওঠেন অনেক ধীর, শান্ত এবং বিচক্ষণ একজন !